করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগ কার্যত কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদেরা কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে কথা বলছেন। তবে সরকার বেছে নিয়েছে মধ্যপন্থা।
করোনা সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার মুখে সরকার পর্যটন বন্ধ করল প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়, পরে কক্সবাজারে ও সারা দেশে। একই সময় দেশের সব জায়গায় পর্যটন বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন হলো না, তা কেউ জানে না। সরকার গণজমায়েত বা সমাবেশ না করার পরামর্শ দিলেও গতকাল শুক্রবার ব্যাপক জনসমাগমের মধ্য দিয়ে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। এই পরীক্ষা পেছালে বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না। ইউরোপ ও অন্য ১২টি দেশ থেকে যাত্রী আসার ব্যাপারে কড়াকড়ি করল ঠিকই, কিন্তু সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেক দূর গড়ানোর পর। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের করোনার টিকার সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা পাওয়া যায় প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার সময়ের পার্থক্য যদি ১২ সপ্তাহ হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথমে দুই ডোজের সময়ের পার্থক্য করেছিল চার সপ্তাহ, পরে আট সপ্তাহ। গত এক বছরে এ ধরনের ঘটনার আরও অনেক উদাহরণ আছে।
ঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিকল্পনার অনুপস্থিতি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের উদাসীনতায় রেকর্ড ভেঙে প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়ছে। গতকাল নতুন ৬ হাজার ৮৩০ জন আক্রান্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।
গতকাল ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা শহরে সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। তারা প্রতিদিন যে নমুনা পরীক্ষা করছে, তার অর্ধেকেই করোনা শনাক্ত হচ্ছে।
নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করেন, বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের ব্যক্তি, যাঁদের উপসর্গ নেই এমন অনেকেরই নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা থেকে তাঁদের নমুনা বাদ দিলে দেখা যাবে আক্রান্তের হার আরও অনেক বেশি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক দূর গড়াবে।
প্রস্তুতির ঘাটতি: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ দেখা গেছে। বাংলাদেশেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে প্রায় ছয় মাস আগে থেকে আলোচনা হয়ে আসছে। যখন ঢেউ এল তখন দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রস্তুত নয়। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে, হাসপাতালে শয্যাস্বল্পতার আশঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় ৫ জানুয়ারি দেশে করোনাভাইরাসের ‘ইউকে ভেরিয়েন্ট’ শনাক্ত হওয়ার পর। কিন্তু তখন যুক্তরাজ্য থেকে যাত্রী আসার ব্যাপারে কড়াকড়ি পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) সাত দিন, এমনকি চার দিন করার কথাও বলা হয়েছিল। ভাইরাসবিজ্ঞানীরা বলছেন, কোয়ারেন্টিন ১৪ দিন হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির নাম না প্রকাশে একজন সদস্য গতকাল বলেন, এক মাস আগে থেকেই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সুস্পষ্ট দেখা গেছে। তখনই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু নেওয়া হয়নি।
১ মার্চ নতুন শনাক্ত ছিল ৫৮৫ জন, শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৩১। এরপর থেকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হার নিয়মিত বেড়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘নিয়মিত সাপ্তাহিক পর্যালোচনায় মার্চ থেকেই বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি।’ তখন কেন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি—এমন প্রশ্নের উত্তরে তাহমিনা শিরীন বলেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য বিভাগের একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিষয় ছাড়াও চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রস্তুতির ঘাটতি চোখে পড়ছে। গতকাল ঢাকা শহরের কোভিডের জন্য নির্ধারিত ১০টি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা খালি ছিল মাত্র ৪৭টি। অন্যদিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে বেশি কোভিড রোগী ভর্তি ছিল। গত দুই দিনে একাধিক রোগীকে ভর্তির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছে এমন খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে প্রথম আলোতে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা বহুদিন বন্ধ থাকার পর কিছুদিন আগে তা বিভিন্ন হাসপাতালে চালু হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার কিছু হাসপাতালে শয্যা বাড়াতে হবে, কোনো কোনো হাসপাতালের পুরোটা কোভিডের জন্য নির্ধারণ করতে হবে। এতে অনেক জটিলতা। আমাদের সম্পদ ও সামর্থ্যের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।’ তিনি বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি হাসপাতাল, মানসিক হাসপাতাল, হৃদ্রোগ হাসপাতাল, মহানগর হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শুরুতে কী হয়েছিল: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন একটি ভাইরাসে সংক্রমণের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে দেশের বিমানবন্দরসহ সব স্থল ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু করে সরকার। ২১ জানুয়ারি সংক্রমণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। ২২ জানুয়ারি থেকে আইইডিসিআর নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিং শুরু করে। ২ ফেব্রুয়ারি উহান থেকে ৩১২ জন প্রবাসীকে দেশে এনে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখে সরকার। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর জানা যায়।
মহামারি মোকাবিলার জন্য মার্চ মাসেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় প্রস্তুতি ও মোকাবিলা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি: বিদেশ থেকে করোনাভাইরাসের আগমন নিয়ন্ত্রণ, দেশের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং করোনায় আক্রান্তদের শনাক্ত করে পৃথকভাবে চিকিৎসা দান।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রধান কাজ দুটি। প্রথমত: মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। দ্বিতীয়ত: নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করা (টেস্ট), শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি চিহ্নিত করা, শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির চিকিৎসা দেওয়া এবং তাঁদের আলাদা রাখা।
গত বছর এসব কাজ ঠিকমতো হয়নি। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগ বা সরকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। অনেকে মাস্ক পরছে না বা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
চীনে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেই চীনই কয়েক মাসের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনে।
চীন থেকে ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল ৮ জুন বাংলাদেশে এসেছিল। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুই সপ্তাহ কাজ করার পর একটি প্রতিবেদন দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখায়। এতে উঠে আসে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের দুর্বলতার বিষয়গুলো। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়: সম্পদ বণ্টনে, আন্ত খাত সহযোগিতায় ঘাটতি আছে। অধিকাংশ কর্মকর্তা রোগনিয়ন্ত্রণের চেয়ে চিকিৎসার ব্যাপারে বেশি মনোযোগী। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।
এক বছর পরে এসে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কী করেছে, তা জানার জন্য গতকাল এই প্রতিবেদক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালকের কাছে ১০ বার ফোন করেন, এরপর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠান। কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর যোগাযোগ করলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে কাজ করতাম। এই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’ আপনি কি তাদের প্রতিবেদন দেখেছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে মহাপরিচালক বলেন, ‘আমি তখন মহাপরিচালক ছিলাম না। আমাকে কেউ ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানাননি।’
মধ্যপন্থায় সরকার: তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষা করতে হলে লকডাউনের মতো পথ বেছে নিতে হবে বলে জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ মত দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘সংক্রমণের বর্তমান হারে যেকোনো বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কার্যকর পন্থা হিসেবে লকডাউনের কথাই বলবেন। আমি বলব ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও গাজীপুর—এই চারটি বড় শহরে ১৪ দিনের জন্য কারফিউ বলবৎ করতে হবে। অন্য যে শহরে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, যেমন মৌলভীবাজার, সেখানে একই ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অনেক মূল্য দিতে হবে।’
কিন্তু ১৪ দিন মানুষ কীভাবে চলবে, জীবিকার কী হবে—এই প্রশ্নের উত্তরে মো. সায়েদুর রহমান বলেন, এই শহরগুলোতে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার খরচ ও তাদের অসুস্থতাজনিত ক্ষতির আর্থিক মূল্য অনেক বেশি। সেই হিসাব কখনো আমলে নেওয়া হয় না।
তবে সরকার কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না বলে অনেকেই মনে করছেন। সরকার গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে এবং পরে কিছু ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করে। ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির বিরূপ প্রভাব পড়ে মানুষের জীবিকার ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। অনেকেই মনে করেন, সরকার সর্বাত্মক লকডাউনে না গিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।
আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘সরকার মধ্যপন্থা নিয়েছে। নীতিনির্ধারকদের কাছে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম বলেন, ‘সংক্রমণ ছড়াক, মানুষের মৃত্যু হোক, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হোক—এর কোনোটি সরকার চায় না। সরকায় চায় মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন আচরণ করুক এবং কলকারখানা, অফিস, আদালত চালু থাকুক।’