নিজস্ব প্রতিবেদক
বেকারত্ব ঘুচিয়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে ২০১৯ সালে উত্তরা ইপিজেডে টেক্সটাইল মিল চালু করে দেশবন্ধু গ্রুপ। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের। এছাড়া শতভাগ রপ্তানিবান্ধব এই প্রতিষ্ঠানে এমব্রয়ডারি, ডেনিম গার্মেন্টস, ওয়াশিং ইউনিট এবং প্রিন্ট সুবিধা রয়েছে। যা থেকে প্রতিবছর এখান থেকেই ১১১ কোটি ৭৪ লাখ ৭২ হাজার পিস ডেনিম চিনো, কার্গো প্যান্ট, আউটওয়্যার, ফেন্সি এ্যাপারেলস উৎপাদন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশবাংলার এই টেক্সটাইলসে (ডিটিএএল) ১৬টি আলাদা ফ্লোর ইউনিট করা হয়েছে। যার আয়তন ৭১৭৫০ বর্গফুট এবং সর্বমোট আয়তন ২৭১২৭২ বর্গফুট।
কারখানায় কর্মরত কর্মীর ৯৫ শতাংশ স্থানীয় বাসিন্দা। তাদের সবাই নিজেদের কর্মে ও প্রাপ্য বেতন-ভাতায় ব্যাপক সন্তুষ্ট। ১২ হাজার ৮০০ টাকার কম কারো বেতন নেই। দক্ষতা অনুসারে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন কর্মীরা। তবে ২৫ হাজার টাকার বেশি বেতনের কর্মী সংখ্যা অনেক কম। প্রতিষ্ঠানকে ভালোবেসে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করেন কর্মীরা।
আঁখি নামে এক কর্মী জানান, আগে ঢাকার সাভারে কাজ করতেন। সেখানে ওভার টাইমসহ মোট ১৮ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পেতেন, তা দিয়ে ঘরভাড়া ও খাওয়া-দাওয়ার পর হাতে বেশি টাকা থাকতো না। কিন্তু এখানে ওভার টাইম ছাড়াই ১৪ হাজার ৩০০ টাকা বেতন পান। পাশেই বাড়ি হওয়ায় বাড়তি কোনো খরচ নেই বললেই চলে। ফলে পুরো টাকাই হাতে থাকে।
সাইফুল নামে আরেক কর্মী বলেন, তিন বছর ধরে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসে কাজ করছি। কাজের পরিবেশ ও কর্মকর্তাদের ব্যবহার এক কথায় অমায়িক। আমি এর আগে গাজীপুরের একটি কারখানায় কাজ করতাম। এ ধরনের পরিবেশ সেখানে পাইনি। করোনার সময় কারখানা বন্ধ হওয়াতে এলাকায় চলে আসি। বাড়িতে এসেই দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের খবর পাই৷ বর্তমানে বেতন ১৯ হাজারের টাকার চেয়ে বেশি। এলাকায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালোভাবেই দিন কাটছে।
দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের জেনারেল ম্যানেজার (প্রডাকশন) ইসুরু উমেশ বলেন, উত্তরবঙ্গে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালে। এটিই বর্তমানে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানা। এখানে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চায়না-বাংলা যৌথ ব্যবস্থাপনায় কারখানার উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। তবে এখানকার উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা শতভাগ বিদেশি। উত্তরা ইপিজেডের ২৩টি কোম্পানি বিনিয়োগ করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের মালিক-শ্রমিক ও কর্মচারীদের সম্পর্ক যেকোনো কারখানার চেয়ে অনেক ভালো। এক কথায় আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলতে যা বুঝায় দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস তার বাস্তব উদাহরণ।
তিনি আরো বলেন, গার্মেন্টস ব্যবসায় একটি বড় সমস্য শিপমেন্ট বাতিল। তবে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস চালুর পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো শিপমেন্ট বাতিল হয়নি। ইপিজেড ও কাস্টম নীতিমালা মেনে সঠিক প্রক্রিয়ায় শিপমেন্টের মাধ্যমে রপ্তানি করা হচ্ছে উৎপাদিত পণ্য।
রপ্তানি কাজকে আরো সহজ করতে ইপিজেডের পাশে একটি রেল স্টেশন স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) মো. ইব্রাহিম আকন বলেন, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের উৎপাদিত পণ্য শতভাগ রপ্তানি হয়। বর্তমানে ইউরোপের বড় দুটি দেশ এখানকার উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা। এর একটি হচ্ছে ইউএসএর জি-থ্রি, কসকো ও ডিকনি। অন্যটি হলো স্পেনের ম্যাঙ্গো কোম্পানি। নতুন করে আরো কয়েকটি দেশ ও কোম্পানিকে যুক্ত করার জোর চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ইউকের প্রাইমার্ক কোম্পানিটি মোটামুটি আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে কয়টি কোম্পানির অর্ডার রয়েছে তা ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারখানায় বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। অটো সেটআপ মেশিন স্থান পেয়েছে দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলে৷ যা দেশের হাতে গোনা কয়েকটি কারখানায় ব্যবহৃত হয়।
‘সবমিলে অনেক শ্রমিকের কাজ অনেক কম সময়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। তারপরেও দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলের নতুন আমদানিকারক যুক্ত হলে কারখানার পরিধি ও দক্ষ কর্মী আরো বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে নতুন আরো একটি প্লটে নতুন একটি শেড স্থাপনের কাজ চলছে। এই কাজকে আরো দ্রুত এগিয়ে নিতে মোটা অঙ্কের টাকার প্রয়োজন। সহজ শর্তে ব্যাংক লোন পেলে উত্তরা ইপিজেডের এই কারখানাকে বিশ্বের অন্যতম কারখানায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসের হেড অব এইচআর, অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লাইন্স মো. আশরাফ উল্লাহ বলেন, দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস বিদেশে পোশাক রপ্তানি করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে, তেমনই মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কর্মসংস্থান ব্যাপকহারে সৃষ্টি হয়েছে। এক কথায় দেশবন্ধু গ্রুপের মতো কোম্পানির কারণে অতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের দরিদ্র দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে উত্তরা ইপিজেড। বর্তমানে ২৬০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে ইপিজেডটি। এই ইপিজেডের ব্যাপক চাহিদার কারণে এর আকার আরো বেড়ে প্রায় ৩০০ একর হচ্ছে। বর্তমানে ২৩টি কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছে। সমগ্র উত্তরা ইপিজেডের কাজ তরান্বিত করতে ও রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে উত্তরবঙ্গের অবকাঠামো আরো সংস্কার ও উন্নয়ন দরকার।
এলাকায় পোশাক শ্রমিক অহরহ থাকলেও দক্ষ কর্মীর বড় অভাব রয়েছে। কারণ গার্মেন্টে অনেক সূক্ষ্ম কাজ রয়েছে যা বাস্তবায়ন করতে দক্ষ কর্মীর বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ এলাকায় সে ধরনের সুযোগ কম উল্লেখ করে আশরাফ উল্লাহ বলেন, ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় শত শত কারখানা থাকায় চাহিদা মতো কর্মী যখন তখন পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই। কিছু কিছু কর্মীকে বাছাই করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত না। এ কারণে এখানে আরো কয়েকটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে উত্তরবঙ্গের চেহারা পাল্টে যাবে।
আশরাফ উল্লাহ আরো বলেন, এই ইপিজেডে দেশবন্ধু টেক্সটাইলসহ মাত্র তিনটি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এখানো আরো কয়েকটি কারখানা চালু হলে উত্তরা ইপিজেড গার্মেন্টসের হাব হবে।