বর্তমান সময় ডেস্ক:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের উপকণ্ঠে অবস্থিত খুলনা জেলার সাহিত্যচর্চার প্রাথমিক পর্ব শুরু হয় লোকসাহিত্য ও লোকসংগীত চর্চার মাধ্যমে। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এ ধারায় সাহিত্যচর্চা চলেছে। কথকতা, পাঁচালী, সারিগান, ভাটিয়ালি গান, অষ্টক ও চড়কসংগীত, গাজীর গীত ও মানিক পিরের ছড়া, জারি গান, গাজং-কালু-চম্পাবতীর কিস্সা, দক্ষিণারায়ের কাহিনি, বনবিবি-বনদুর্গার মাহাত্ম্য কাহিনি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রের ব্যাখ্যার সঙ্গে সরল ও সরস ভাষায় যে বিশদ ব্যাখ্যা হয়, তারই নাম কথকতা।কথকচূড়ামণি বিশ্বেশ্বর শিরোমণি এ ধারায় সবচেয়ে খ্যাতিমান কথক ছিলেন। খুলনা ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত, এর চারপাশে অসংখ্য ছোট বড় নদী প্রায় সব সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সাগরের সঙ্গে মিশেছে। নদীবহুল খুলনা অঞ্চলে বর্ষাকালে কৃষক ও মৎস্যজীবীরা এর প্রধান গায়ক। আষাঢ় মাসে রথযাত্রায়, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজায়, ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পূজায় এবং বিজয়া দশমীর ভাসানে নৌকা বাইচের সময় এ গানের অধিক প্রচলন ছিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যালোকে গৃহপানে ধাবিত শ্রান্ত-ক্লান্ত নিরক্ষর মাঝি নদীর বুকে শ্লথ হস্তে বৈঠা টানতে টানতে উদাস মনে গাইতে থাকে-
তুমি পারের কর্তা, জেনে বার্তা, ডাকি হে তোমারে।
চৈত্র মাসে চড়কপূজার সময় হতো অষ্টকগান। আর ছিল গাজীর গীত ও মানিক পিরের ছড়া। মুসলমান ও হিন্দুরা গাজীর গীতের দল করে-নানা স্থানে গেয়ে বেড়াতেন। তাদের গানের মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিফলিত হতো। কবি ও বাউল সংগীতের ধারাও ছিল এ অঞ্চলে। খুলনায় নিকটবর্তী জাপসা গ্রামে ক’বেল কামিনী নামে একজন পোদ-রমণী তার ভাগিনীপুত্র তারাচাঁদ ও অন্যান্য গীতের দলের জন্য অসংখ্য কবিত্বপূর্ণ গান ও শ্লোক রচনা করে দিতেন। এ ছাড়া ছিল জারি গান। খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, ফরিদপুর, বরিশাল এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসংখ্য জারি গানের দল ছিল।
আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যচর্চা শুরু হলে খুলনা অঞ্চলে তার প্রভাব পড়ে। এ প্রভাবের অন্যতম কারণ খুলনা ও কলকাতা শহরের ভৌগোলিক নৈকট্য। বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক রূপকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬০ সালে চাকরি নিয়ে খুলনায় এসেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে। তার প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী এখানে বসেই লিখেছিলেন। তা ছাড়া ‘কপালকুন্ডলা’ ও ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে খুলনার প্রভাব আছে। খুলনা জেলার সাহিত্যাঙ্গনে প্রথম উচ্চারণ করতে হয় কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের (১৮৩৪-১৯০৭) নাম। দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রামের এ কবি ‘নীতিকবি’ হিসাবে পরিচিত। তার রচিত ‘সদ্ভাবশতক’-এর বহু কবিতা এখনো পাঠকের মুখে শোনা যায়।
যে জন দিবসে মনের হয়ষে জ্বালায় মোমের বাতি
আশু গৃহে তার জ্বলিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি
‘সদ্ভাবশতকে’র কবিতার চরণ এটি। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে মোহভোগ (১৮৭১), রাসের ইতিবৃত্ত (১৮৬৮), কৈবল্যতত্ত্ব, শিববিবাহ, নীতিস্তবক, শিবপঞ্চাশৎ প্রভৃতি। তা ছাড়া কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ছিলেন তৎকালীন ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় অনুশীলনী দলের সদস্য খুলনার সেনহাটি গ্রামের হীরালাল সেন ‘হুঙ্কার’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখে ব্রিটিশ সরকারের রাজরোষে পড়েন। এ জন্য তার নামে খুলনা কোর্টে মামলা হয়। সেই মামলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাক্ষ্য দিতে আসেন। কারণ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সেই মামলায় কবি হীরালাল সেন ১৯০৮ সালে দেড় বছর কারাভোগ করেন। মুনসী খয়রাতুল্লা (১৯৪২-১৯৩৬) ছিলেন মধুসূদন প্রভাবিত কবি। তিনি কারবালা তরঙ্গকাব্য (১৯০৭), তারিফে রসুল, খোদা হাফেজ প্রভৃতি কাব্য রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃকুল ও মাতৃকুলের আদিনিবাস খুলনাতে। তার পূর্বপুরুষের বাসস্থান ছিল খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ এবং মাতৃকুলের বাসস্থান ছিল খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে। ওই একই গ্রামে রবীন্দ্রনাথেরও শ্বশুরবাড়ি। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান নাট্যকার ও গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চাকরি সূত্রে খুলনায় এসেছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। খুলনায় থাকাকালে তিনি তৎকালীন খুলনা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন। তার লিখিত ‘বিরহ’ ও ‘রানা প্রতাপ’ নাটক দুটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই খুলনা থিয়েটারের মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল তারই তত্ত্বাবধানে। তিনি নিজেও এখানে অভিনয় করেছিলেন। বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় খুলনার কৃতী সন্তান। রসায়ন বিজ্ঞানী ও রসায়নের শিক্ষক হলেও সাহিত্যের প্রতি তার ছিল গভীর দরদ। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক তার রচিত অনেক প্রবন্ধ রয়েছে। তা ছাড়া খুলনা, রাজশাহী, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে সাহিত্য সম্মেলনে তিনি পৌরহিত্য করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জাতীভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩) বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান মহিলা কবি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রিয়প্রসঙ্গ (১৮৮৪), বাঙালি রমণীদের গৃহধর্ম (১৮৯০), কুসুমাঞ্জলি (১৮৯৩) কনকাঞ্জলি (১৮৯৬) বীর কুমার বধ (১৯০৪), শুভসাধনা (১৯১১), বিভূতি (১৯২৪), সোনার সাথী (১৯২৭) প্রভৃতি। ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক সতীশচন্দ্র মিত্র ইতিহাসের শিক্ষক হলেও সাহিত্য সাধনায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার রচিত মা (১৮৯৬) প্রতাপসিংহ (১৯০৪), উচ্ছ্বাস (১৯০৮), হরিদাস ঠাকুর (১৯২৪), সপ্তগোস্বামী (১৯২৭) এসব ছাড়াও তার লেখা গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ সে সময় কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তিনি ‘কাব্যসিন্ধু’ ও ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি পেয়েছিলেন। আব্দুল গফুর সিদ্দিকী (১৮৭২-১৯৫৯) বসিরহাট থেকে খুলনার বাসিন্দা হয়েছিলেন। তার গ্রন্থের নাম তিতুমীর (১৯১৬), মুসলমান ও বঙ্গসাহিত্য (১৯২২), বিষাদসিন্ধুর ঐতিহাসিক পটভূমি প্রভৃতি। সাহিত্যিক বিধুভূষণ বসুর জন্ম বাগেরহাটে হলেও তিনি খুলনায় বসে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তার লেখা নাটক খুলনা শহরের একাধিক স্থানে মঞ্চস্থ হয়েছে। সাহিত্য রচনার কারণে এ লেখক ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসকের হাতে দণ্ডিত হয়েছিলেন। লক্ষ্মীমেয়ে, চারুচন্দ্র, অমৃতগরল, সুভদ্রা, পাপিষ্ঠা, গোধন, প্রখরা, ফুলের কলি, কামিনী কাঞ্চন, বিয়ের বাতাস, পরিণাম, বনমালা প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ‘বনমালা’ গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেছিল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক কাজী ইমদাদুল হকের (১৮৮২-১৯২৬) জন্ম খুলনার পাইকগাছায়। তার আব্দুল্লাহ (১৯৩৩) কালজয়ী উপন্যাস। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে আঁখিজল, লতিকা, প্রবন্ধমালা ও নবী কাহিনি উল্লেখযোগ্য। কাজী আকরম হোসেনের উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ-ইসলামের ইতিহাস, নত্তরোজ, পল্লীবাণী, আমরা বাঙ্গালী, যুগবাণী, করিমা-ই-সাদী প্রভৃতি। কবি ইসমাইল হোসেন(১৮৯৮-?) দৌলতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। দৃষ্টিহীনতার কারণে তিনি ‘অন্ধকবি’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থ-মরণবরণ, মায়ার বাঁধন, যুগের আলো, ঈদের সওদা, দরদী, স্বাস্থ্যগাথা, মরুরদুলাল। ডা. আবুল কাশেম (১৯০২-১৯৮৭) খুলনার খ্যাতিমান সাহিত্যিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ-মানসী, হযরত মোহাম্মদ, মহর্ষি মহসিন, ঈশা খাঁ, স্বর্ণময়ী, আমার ভূ-প্রদক্ষিণ, দূরদূরান্তরে, পঞ্চনদের দেশে ও বিজ্ঞানের জন্মরহস্য। গাজী শামসুর রহমান আইনের লোক হলেও তিনি সাহিত্য রচনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। আইনের চোখে, আইনের আলোকে, রাহেলার মামলা, নয়াশপথ, কলরোল, ঝলক, কালিকলম প্রভৃতি তার সাহিত্যকীর্তি। এএফএম আব্দুল জালিল (১৯১৩-১৯৭৮) ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থ লিখে খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি প্রচুর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার গ্রন্থগুলো হলো-মুসলিম সংস্কৃতি, পারস্য সাহিত্য, আমার কথা, আইয়ুব আমলের ভূত প্রভৃতি। মুহম্মদ আব্দুল হালিম (১৯২৯-……) পেশায় আইনজীবী কিন্তু তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, যে ফুল না দুটিতে, ক’দিনের এই দেখা, মহানবির দেশে তার লেখা গ্রন্থ।
বিএসডি/জেজে