বিজনেস ডেস্ক:
সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ)। খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতি নিয়েও সংস্থাটি প্রশ্ন তুলেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার বিষয়টি উত্থাপন করেছে।
এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সূচকের অবনতিতেও নাখোশ সংস্থাটি। রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়েও তারা আপত্তি করেছে। তাদের মতে, সামান্য চাহিদা বাড়ার কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও হঠাৎ করে রেমিট্যান্স কমে যাওয়া অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে দুর্বল করে দিচ্ছে।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আইএমএফের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা অর্থনীতির ওইসব সূচকে এসব ঘাটতিগুলো সমন্বয় করার সুপারিশ করেন।
আইএমএফের মিশনের সঙ্গে প্রধান বৈঠকটি হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান ও একেএম সাজেদুর রহমান খান, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। আইএমএফের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির প্রধান রাহুল আনন্দ।
১০ দিনের সফরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বা মিশন ঢাকায় এসেছে। দলটি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। এ সময় দলের সদস্যরা অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তারা। এর অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম দফার বৈঠকটি রোববার অনুষ্ঠিত হয়। সব শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার ৮ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকে এ হার ২০ শতাংশের বেশি।
এছাড়া খেলাপি ঋণের সঠিত তথ্য উপস্থাপন হচ্ছে না। একদিকে নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ রয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে তারা আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছেন। তা না হলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য প্রকাশের কথাও তারা বলেছেন। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, খেলাপি ঋণের হিসাব দুইভাবে করা হয়। একটি গ্রস এবং অপরটি নিট। গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। এ হার ৩-৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। করোনার কারণে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিমাণ হচ্ছে ১৭ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে আইএমএফ প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলেছে, রিজার্ভে এমন সব বৈদেশিক মুদ্রা দেখানো হচ্ছে, যেগুলো অন্য খাতে খরচ করা হচ্ছে। এগুলো রিজার্ভে দেখানোর সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এখানে গ্রস ও নিট পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়। নিট হিসাব থেকে অন্যত্র ব্যবহৃত তহবিলগুলো বাদ দেওয়া হচ্ছে।
এত রিজার্ভ থাকার পরও ডলারের চাহিদা বাড়লে এর দাম বেশি বাড়ছে কেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ‘সময়ের অনেক বৈদেশিক দেনা স্থগিত ছিল, সেগুলো এখন শোধ করতে হচ্ছে। যে কারণে হঠাৎ করে চাপ বেড়েছে।’
হঠাৎ করে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো স্বাভাবিক হয়নি। করোনার সময়ে যেসব কর্মী দেশে এসেছেন তারা এখনো যেতে পারেননি-এসব কারণে রেমিট্যান্স কমেছে।
আইন সংশোধনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এরই মধ্যে ৫টি সংশ্লিষ্ট আইন পর্যালোচনা ও পরিমার্জন করে খসড়া বিল আকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইনগুলো হলো-ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১, অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩, প্রস্তাবিত ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন-২০২১, নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট-১৮৮১ ও দেউলিয়া বিষয়ক আইন-১৯৯৭। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্ব ১০ সদস্যের একটি সুপারিশ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি আইনগুলো সংশোধন করে খসড়া বিল আকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইএমএফ ব্যাংকিং খাতে ঋণের অবলোপনের পরিসংখ্যান, কীভাবে বর্তমান খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয় এবং আগামীতে এ পদ্ধতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কিনা-তাও জানাতে বলছে।
আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি ২০১৯ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একটি রিপোর্টে বলেছিল, এ দেশে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা হয়েছে। এখানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার তুলনায় অনেক বেশি। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের অঙ্ক হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।
বিএসডি/এফএফ