অনলাইন ডেস্ক:
নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচারসহ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে গণতন্ত্র। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসেও ভারতে গণতন্ত্রের অনেকটাই অবনতি হয়েছে। এ কারণে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে।
তিনি বলেছেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি একটি দল থাকে, তবে তারা সংসদে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে এবং আইনসভাকে বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়েও শক্তিশালী করতে পারে। নির্বাহী বিভাগ ভারসাম্যহীন এবং অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে স্বাধীনতা, শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে কথা বলার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভারতের স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন। বুধবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছে। খ্যাতিমান এই বাঙালি অর্থনীতিবিদ বলেন, গত এক দশকে ভারত ঠিক উল্টো পথে এগিয়েছে। এটা গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে।
অমর্ত্য সেন বলেন, ভারতের সমস্যার একটি বড় অংশ হলো দারিদ্র্য। তাদের চাহিদার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ অবহেলা দেখাচ্ছে। গণতান্ত্রিক নীতিতে এটি একটি বিপজ্জনক লক্ষণ। অতি দরিদ্রদের স্বার্থের ব্যাপারে শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা খুব কঠিন। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল হলে এটি আরও বেশি হয়। এই সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল এবং এর প্রতিকারের চেষ্টা করা দেশের সবার স্বার্থেই প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ভারত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত ধারায় চলছে। তিনি দেশটির ‘বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন’ বা ইউএপিএর সমালোচনা করে বলেন, এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত খারাপ। কারণ, এ আইনে এমন লোকদেরও গ্রেপ্তার করার অনুমতি দেওয়া হয়, যাদের কোনো অপরাধ নেই বা তাদের আদালতে অভিযুক্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তার পরও তাদের কারাগারে রাখা হয় এই সন্দেহের বশে যে, তারা কিছু করে ফেলতে পারেন। তিনি পরিস্থিতিটিকে ব্রিটিশ
আমলের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, তখন তার কাকারা প্রতিরোধমূলক আইনে আটক হয়ে জেলে ছিলেন। তারা কিছু ভুল করেছিলেন তা নয়। বরং তারা কিছু ভুল করতে পারেন আশঙ্কা করে তাদের জেলে আটকে রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করিনি স্বাধীন ভারতেও এটি অব্যাহত থাকবে। তবে তাই হয়েছে।’
ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে অমর্ত্য সেন বলেন, গত দুই বছর ধরে স্কুল বন্ধ। তিনি অল্পবয়সী স্কুলছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত। তবে তা শুধু মহামারি এবং গত দুই বছরের কারণে নয়। দেশটিতে শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ, কোনো মহামারি না থাকলেও তা কার্যকর ফল দিতে পারছে না।
তিনি বলেন, ‘স্কুলে এখন যা শেখানো হয় তাতে বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু এগুলো যদি গণিত নিয়ে গর্ব করার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়, আমি মনে করি আপনি একটি বড় ভুল করছেন। এই সমস্যাটি বৃহৎ আকারে উপস্থিত হয়েছে এবং এটি গত দশকে বেড়েছে।’ তবে তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছি, যেমন আমার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে।’
ভারতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা বনাম কৃষকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাফল্যের প্রশ্নে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের উভয়ই প্রয়োজন। কখনও কখনও একটি বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্দোলনকারী ভারতীয়দের একত্রিত করেছিল। তাই নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা দূর হবে না। কিন্তু নিজের মতো করে দাঁড়াতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।’
কল্যাণ অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত অমর্ত্য সেন বলেন, এসব সত্ত্বেও তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। এ কারণে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট ধরে রেখেছেন। একজন ভারতীয় হিসেবে তিনি গর্বিত। তবে অবমাননাকর বৈষম্য দেখলে এই ৮৮ বছর বয়সে দুর্বল শরীর নিয়েও তিনি অবশ্যই প্রতিবাদ করবেন। সূত্র:সমকাল।
বিএসডি /আইপি