বিএসডি অনলাইন
কোন রকম আঘাত ছাড়াই বিভিন্ন বয়সী বেশির ভাগ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় ঘাড় ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ঘাড়ের মাংসপেশি, লিগামেন্ট, স্নায়ু, হাড়জোড়া, তরুণাস্থি বা ডিস্ক বিভিন্ন প্রকার সমস্যার জন্য ঘাড় ব্যথা হয়ে থাকে।
প্রধান কারণ :
- ঘাড়ের অবস্থানগত ত্রুটির জন্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অস্বাভাবিকভাবে ঘাড় বাঁকা করে কোনো কাজ করলে (যেমন- কম্পিউটারে কাজ করা, টেলিভিশন দেখা, লেখালেখিবা গৃহস্থালির কাজ করা) ঘাড়ের মাংসপেশি, স্নায়ু ও হাড়ের ওপর বেশি চাপ পড়ে; ফলে ঘাড় ব্যথা হয়। (পজিশনাল বা পসচারেল নেক পেইন)।
- ঘাড়ের মাংসপেশি কোনো কারণে শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাত হওয়া (টরটিকলিস)। আমাদের ঘাড়ের দুই পাশে দু’টি প্রধান মাংসপেশি থাকে। যার নাম স্টারনোক্লেইডোমাস্টয়েড। এই মাংসপেশি আমাদের ঘার নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। কোনো কারণে এই মাংসপেশি শক্ত হয়ে ঘাড় এক দিকে কাত হলে ঘাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়।
- ঘাড়ের মাংসপেশি বা লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া (স্প্ৰেইন/স্ট্রেইন)।
- ঘাড়ে অতিরিক্ত হাড় থাকা (সারভাইকেল রিব)। এই অতিরিক্ত হাড়ের ফলে ঘাড়ের রক্তনালী ও স্নায়ুতে চাপ পড়ে। ফলে ঘাড়ে ব্যথা হয়।
- ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্ক সরে যাওয়া (ডিস্ক প্ৰলাপস)।
- ঘাড়ের হাড়, জোড়া বা ডিস্কের ক্ষয় বা বৃদ্ধি (সারভাইকেল স্পনড়াইলোসিস)। এটি বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। এতে ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী স্থান কমে যায় এবং আক্রান্ত হাড়ে হুকের মতো ছোট ছোট হাড় বৃদ্ধি পায়, যাকে অস্টিওফাইট বলে। যার ফলে ঘাড়ের স্নায়ুতে চাপ পড়ে এবং রোগী ব্যথা অনুভব করে।
- ঘাড়ের তরুণাস্থি বা হাড়ের বৃদ্ধির ফলে স্নায়ুর গতিপথ সঙ্কুচিত। (সারভাইকেল কেনেল স্টেনোসিস)।
- ঘাড় থাকে যে স্নায়ুগুলো কাঁধ, বাহু এবং হাতের দিকে নামে সেগুলোতে চাপে পড়া (সারভাইকেল মাইলোপ্যাথি)।
- ঘাড়ের হাড় ভেঙে যাওয়া (ফ্রেকচার) বা হাড় ভেঙে সরে যাওয়া (ফ্রেকচার ডিসলোকেশন)।
- ঘাড়ের হাড় সরে যাওয়া (স্পনড়াইলোলিসথেসিস)।
- ঘাড়ের ইনফেকশন (সেপটিক, যক্ষ্মা)।
- ঘাড়ের তরুণাস্থি বা ডিস্কের প্রদাহজনিত রোগ (ডিস্কাইটিস)। এটি সাধারণত ডিস্ক অপারেশন-পরবর্তী প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
- ঘাড়ের হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া। এতে হাড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়, হাড় ছিদ্ৰযুক্ত হয় এবং হাড়ের গঠন নষ্ট হয়ে যায়। হাড়ের বোন মাস ডেনসিটির অনুপাতে ভারসাম্য নষ্ট হয়; ফলে হাড় ধীরে ধীরে ভঙ্গুর হয়। বয়স্ক পুরুষ বা নারী ও মেনোপজ-পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষয়প্রাপ্ত হাড় ঘাড় ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ (অস্টিওপোরোসিস)।
- ঘাড়ের হাড়ের বিভিন্ন প্রকার প্রদাহ জনিত রোগ (রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস, এনকাইলোজিং, স্পনডাইলাইটিস)।
- ঘাড়ের বিভিন্ন স্নায়বিক সমস্যা, রক্তবাহী নালীর সমস্যা, টিউমার, ক্যান্সার,ইনফেকশন।
- উচ্চ রক্তচাপ, চোখের কিছু অসুবিধা ও দুশ্চিন্তা করা।
- মাথায় ভারী জিনিস বহন করা।
- শরীরের ওজন বৃদ্ধি অথবা অপুষ্টিজনিত কারণ।
শিশুদের ক্ষেত্রে:
- ঘাড়ের দুই পাশের যেকোনো বড় মাংসপেশিতে টান খাওয়া (টরটিকলিস)।
- জন্মগতভাবে ঘাড়ের দুই বা ততোধিক হাড় এক হয়ে যাওয়া (ফিউসড ভাটির্ব্রা)।
- জন্মগতভাবে ঘাড়ের কোন হাড়ে অর্ধেক অংশ তৈরি না হওয়া (হেমি ভার্টিব্রা)।
তরুণদের ক্ষেত্রে:
- ঘাড়ে অতিরিক্ত হাড় থাকা (সারভাইকেল রিব)
- ঘাড়ের দুই হাড়ের মধ্যবর্তী ডিস্ক সরে যাওয়া(ডিস্ক প্রলাপস)।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে:
- ঘাড়ের হাড়, জোড়া বা ডিস্কের ক্ষয় বা বৃদ্ধি(স্পনডাইলোসিস)
- ঘাড়ের হাড় ক্ষয়(অস্টিওপোরোসিস)
- ঘাড়ের তরুণাস্থি বা হাড়ের বৃদ্ধির ফলে স্নায়ুর গতিপথ সঙ্কুচিত হওয়া (সারভাইকেল কেনেল স্টেনেসিস)।
- ঘাড়ের ইনফেকশন (সেপটিক, যক্ষ্মা)।
- ডিস্কাইটিস (ডিস্কের প্রদাহ)।
- ঘাড়ের হাড় ও স্নায়ুর টিউমার।
উপসর্গ:
- ঘাড় ব্যথা ঘাড়েই সীমাবদ্ধ থাকা (এক্সিয়াল নেক পেইন, যেমন- ঘাড়ের মাংসপেশি মচকানো)।
- ঘাড় ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত হয়ে আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। হাত বা হাতের আঙুল অবশ অবশ ভাব অথবা ঝিঁঝিঁ হতে পারে। (রেডিকুলার নেক পেইন, যেমন- ঘাড়ে ডিস্ক প্ৰলাপস)।
- কাঁধ, বাহু, হাত বা হাতের আঙুল দুর্বল হতে পারে।
- সময় সময় হাড় ধরে বা জমে (স্টিফানেস) থাকা এবং আস্তে আস্তে তা বাড়তে পারে।
- ঘাড়ের নড়াচড়া বা সামনের দিকে ঝুকে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
-রক্তের কিছু রুটিন পরীক্ষা।
-প্রস্রাব পরীক্ষা।
-ব্লাড সুগার, ইউরিক এসিড, আরএ ফ্যাক্টর।
ঘাড়ের-
- এক্স-রে
- সিটিস্ক্যান
- এমআরআই
প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা :
প্রথমত, ঘাড়ে ব্যথা না হওয়ার জন্য সঠিক জীবন যাত্রার কিছু নিয়ম মেনে চলা:
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- শুয়ে টিভি না দেখা।
- পড়ালেখা, কম্পিউটারে কাজ করা, গাড়ি চালানো বা অন্য কোন কাজের সময়
- দীর্ঘক্ষণ ঘাড় ঝুঁকিয়ে বা বাঁকিয়ে না রাখা।
- শরীরের ওজন কমানো।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা।
- ঘাড় সোজা রাখার ব্যাপারে সচেতন হওয়া।
- সামনের দিকে ঝুকে কাজ না করা; কাজের মাঝে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়া।
- একটি মধ্যম সাইজের বালিশে শোয়া, যার অর্ধেক মাথা এবং বাকি অর্ধেক ঘাড়ের দিকে থাকবে।
- সুস্থ ব্যক্তিরা একটা ব্যায়াম করতে পারেন। কপালে একটি হাত শক্তভাবে রেখে হাতটিকে মাথা দিয়ে চাপ দেয়া। মাথার চার দিকে হাত রেখে এভাবে ব্যায়াম করা। প্রতি দিকে পাঁচবারের বেশি চাপ না দেয়া। দু-তিন বেলা এ ব্যায়াম করা যেতে পারে।
- দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা।
- প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানো।
সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা:
- পরিমিত বিশ্রাম নেয়া।
- ঘাড়ে গরম সেক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
- চিকিৎসকের পরামর্শ মতো NSAID, Muscle relaxant, Vitamin, Pregabalin জাতীয় ওষুধ সেবন করা।
- প্রয়োজন অনুসারে (যেমন- দূরে কোথাও যেতে হলে) সারভাইকেল কলার ব্যবহার করা।
- মাংশপেশীতে স্পাজম হলে ফিজিওথেরাপিতে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
- সারভাইকেল ট্রাকসন (সারভাইকেল রেডিকুলোপ্যাথি বা সারভাইকেল কেনেল স্টেনোসিস অথবা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিসের ক্ষেত্রে)
- ফিজিওথেরাপি
- ডিস্কাইটিস হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমিত বিশ্রাম ও অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা।
- পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- হাড়সহ ছোট মাছ, দুধ, ডিম খাওয়া।
- সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’ জাতীয় ওষুধ যেমন : Labcal D সেবন করা যেতে পারে।
- বয়স্ক পুরুষ বা নারী এবং মেনোপজ-পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’-এর পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাড়ক্ষয় প্রতিরোধকারী ওষুধ, যেমন- বিসফসফোনেট, এলেনড্রোনিক এসিড, ইবন ড্রোনিক এসিড, জোলেন ড্রোনিক এসিড-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে (যেমন- ঘাড়ের ডিস্ক বেশি পরিমাণে বের হয়ে স্নায়ুতে চাপ দেয়া, ঘাড়ের হাড় ভেঙে বাহু, হাত অবশ হয়ে যাওয়া, ঘাড়ের যক্ষ্মা ইত্যাদি)।
ঘাড় ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘাড় ব্যথার মূল কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা উচিত।
ডা: এসি সাহা।
এমবিবিএস, এমএস (অর্থোপেডিকস)।
বিএসডি/এমএম