তুষার আবদুল্লাহ
ভাইরাল ভিডিওটি সত্য এবং প্রতীকী। নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জা করোনাকালে অসহায় মানুষদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করার সময় একজন বৃদ্ধের বুকে ঘুষি দিয়েছেন। বৃদ্ধের অপরাধ, তিনি ত্রাণ হিসেবে পাওয়া কাপড়টি বদলে নিতে চেয়েছিলেন। ভিডিওতে তার বদলে নেওয়ার চেষ্টাটিও ধরা পড়েছে। পরের দৃশ্যতেই দেখা গেছে কাদের মির্জা বৃদ্ধের বুকের বাম দিকে ঘুষি দিলেন। এ নিয়ে রাত গড়িয়ে সকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় কাদের মির্জার সমালোচনায়।
আমার কাছে ঘটনাটি নতুন বা বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি। বরং কাদের মির্জার দিক থেকে তার স্বাভাবিক আচরণই মনে হয়েছে। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি। রাজনীতির মানুষদের ত্রাণ কাজ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, দেখেছি এ প্রকার কর্মসূচির পর্দার আড়ালের দৃশ্য। ভিডিও ক্যামেরার আগে ছিল যে স্থির চিত্রের কাল, সেই সময়েও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা যে কোনও দুর্যোগে কিংবা শোক দিবসে নেতারা খাবার বা পণ্য বিতরণের সময় নেতারা মানবিক চোখ, মুখ নিয়ে ততক্ষণই থাকেন যতক্ষণ ক্যামেরা থাকে। ক্যামেরা সরে গেলে মঞ্চ থেকে সরে যান নেতারাও। শুধু কি সরে যাওয়া? তাদের হাসিখুশি অবয়বটাও হারিয়ে যায়।
ত্রাণ নিতে গিয়ে, খাবার খেতে গিয়ে ধস্তা-ধস্তি এবং প্রাণহানির ঘটনাও অজানা নয়। আসলে আমরা তাদের যে উদারতা দেখি, তার পুরোটাই লোক বা শীর্ষ নেতাদের দেখানো। জনগণকে ভালোবেসে বা আদর করে মানবতার অবতার হতে নামেন না তারা। এমনও দেখা গেছে গণমাধ্যমের ক্যামেরা সরে যাওয়া মাত্র ত্রাণও ফুরিয়ে গেছে। গণমাধ্যম কর্মীরা বিদায় নেওয়ার পর বেরিয়ে আসে নেতা কর্মীদের স্বরূপ। দুই বড় রাজনৈতিক দলের প্রয়াত নেতাদের উৎসর্গ করা কাঙালী ভোজে দেখেছি- হাসি মুখে খিচুড়ি বিতরণের দৃশ্য ধারণ শেষে, হাত বা বাসন বাড়িয়ে দেওয়া মানুষদের সঙ্গে কী অমানবিক ব্যবহার করা হয়। আসলে রাজনীতি যখন আদর্শের বলয় থেকে বেরিয়ে যায়, যা শুধু ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়, তখন কেউই আর আদর্শের কর্মী বা নেতা থাকে না। হয়ে যায় ভাড়াটে লাঠিয়াল। আদর্শিক ত্যাগ নেই। দলের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়ায় লেনদেনের।
কাদের মির্জা যখন তুলসিপাতার রূপে আর্বিভূত হলেন, তখন অনেকেই রাজনীতির আকাশে রকমারি রঙের মেঘ, চাঁদ দেখতে শুরু করেছিলেন। পরিবর্তনের দক্ষিণা হাওয়াও শরীরে লাগাতে শুরু করেছিলেন অনেকে। গণমাধ্যমও কাদের মির্জাকে ‘লিফট’ দিয়ে তারকার উঁচু মঞ্চে তুলে দেয়। কাদের মির্জা রাজনীতিবীদদের জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয় পথিকৃৎ এর আকার দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমের মাতম দেখে কাদের মির্জাও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নিজ ভাইকে, পুরো দলকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। স্থানীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধে লোক ক্ষয় হয়। শুরু হয় একের পর এক নাটকের মঞ্চায়ণ। দল থেকে পদত্যাগ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একেক বার একের বয়ান দিতে থাকেন। লিফট দিয়ে তোলা নেতার পতন ঘটে। জনগণ বুঝতে পারেন, সবই তার নাটক।
গণমাধ্যমও আলো সরিয়ে নেয় কাদের মির্জার ওপর থেকে। এমন কাদের মির্জা গং আমাদের রাজনীতিতে নিয়মিত বিরতিতে আর্বিভূত হন। তাদের কেউ কেউ সংসদের চৌকাঠও পেরিয়ে যান। জনগণ, দল কেউই তাদের ফাঁপা আদর্শ, মায়াকান্নার অভিসন্ধি বুঝতে পারে না। এক সময় ঠিকই খোলস খসে পড়ে। এই খোলসে লুকিয়ে থাকা লোক গুলোই জনগণকে গুলি করে, ঘুষি দেয় এবং হত্যা করে আদর্শ। সুতরাং কাদের মির্জা ঘুষি শুধু একজন বৃদ্ধকে দেননি। তিনি এই ঘুষির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন, জনগণ ছাড়াই আজকাল ‘নেতাগিরি’ চলে। দলীয় আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিই মহিরুহ এখনকার গণতন্ত্রে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী