ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খুলনায়। আজ মঙ্গলবার সকালের জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে কয়েক ফুট। এতেই বাঁধের কানায় কানায় উঠেছে পানি। কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদী রয়েছে উত্তাল, মেঘলা আকাশের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলীয় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা এলাকার মানুষ। যেকোনো ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন তাঁরা। ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন বাঁধ।
খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, সকাল নয়টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি এখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ায় বেড়ে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোংলা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী সংকেত দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঝড় যখন উপকূলে আঘাত হানবে, তখন নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বৃদ্ধি পাবে। সকাল থেকে যে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে, তা ইয়াসের প্রভাবেই হচ্ছে।
এদিকে জোয়ারের পানি যেন বাঁধ উপচে বা ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ সংস্কারের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত কয়েক দিন চলা ওই কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
খুলনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ হলো কয়রা উপজেলায়। ওই উপজেলায় ১৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেক ঝুঁকিপূর্ণ। উপজেলাটি পাউবো সাতক্ষীরা বিভাগ-২-এর আওতায়।
ওই বিভাগের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, কয়রা উপজেলার ২৪টি স্থানের বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ইয়াসের প্রভাব থেকে কয়রাবাসীকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সেই স্থানগুলোয় কাজ করা হচ্ছে। সকালে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৪ থেকে ৫ ফুট বেড়েছে। জোয়ারের পানি এমন থাকলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে যদি পানির উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট হয় ও বাতাসের তীব্রতা বাড়ে, তাহলে বাঁধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
খুলনার সবচেয়ে দক্ষিণের ইউনিয়ন কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী। চারদিকে নদী আর তিন পাশে সুন্দরবনঘেরা ওই ইউনিয়নেই যেকোনো ঝড় সবার আগে আঘাত হানে। আইলার সময় ইউনিয়নের প্রায় অর্ধেক গ্রাম পাঁচ বছরের মতো নোনা পানিতে তলিয়ে ছিল। বুলবুল ও আম্পানেও ব্যাপক ক্ষতি হয় ওই ইউনিয়নের মানুষের। ইউনিয়নের ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটারই ঝুঁকিপূর্ণ।
ওই ইউনিয়নের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর আম্পানের পর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নামমাত্র ওই কাজ করে টাকা লুটপাট করেছে। এ কারণে সকালে জোয়ারের পানি একটু বাড়লেই ওই স্থানগুলো দিয়ে উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এখন বাঁধ সংস্কারে মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন।
খুলনার সবচেয়ে বড় নদী হলো শিবসা। দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়ন ও পাইকগাছার গড়াইখালী ইউনিয়ন পড়েছে ওই নদীর দুই পাড়ে। গড়াইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা সাফায়েত হোসেন বলেন, সকালে জোয়ারের পানি ও নদীর ঢেউয়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক জায়গায় বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। দুপুর ১২টা থেকে ভাটা হওয়ার কথা থাকলেও নদীর পানি মোটেও কমেনি। এ কারণে ওই এলাকার মানুষে বেশি আতঙ্কিত।
ওই নদীর তীরে সুতারখালী ইউনিয়নের নলিয়ানে রয়েছে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জ কার্যালয়। রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবু সালেহ বলেন, উত্তাল রয়েছে নদী। সকালে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আর একটু বাড়লেই বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকবে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের মধ্যে থাকা কয়েকটি টহল ফাঁড়ি পানিতে ডুবুডুবু অবস্থা হয়েছে। বনরক্ষীদের যেসব টহল ফাঁড়ি পাকা ভবন, সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র, নথি, নৌযান ও জব্দকৃত মালামাল নিরাপদে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে জেলার নয়টি উপজেলায় ১ হাজার ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উপকূলীয় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলাকে। ৪ নম্বর সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া শুরু হবে। এ ছাড়া ১৬টি মেডিকেল টিম, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তুত রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও।