দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী
মান্নাদার মতো প্রেমিক সারা বিশ্বে বিরল। প্রেমের জোয়ারে হৃদয়ের এ কূল ও কূল ভাসিয়েছেন সারা জীবন।
ঈশ্বর যতখানি প্রেম দিয়ে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, জীবদ্দশাতেই তার অনেক বেশি খরচ করেছিলেন মান্নাদা।
সস্ত্রীক বাংলাদেশে গিয়েছেন অনুষ্ঠান করতে। মান্নাদার গানে বাংলাদেশ উত্তাল। দারুণ উন্মাদনা। অনুষ্ঠানের শেষে মান্নাদা যে হোটেলে রয়েছেন, সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা । ভাল মুডে আছেন। বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন ‘আচ্ছা মান্নাদা, জীবনে তো অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, আপনার কাছে সব থেকে মূল্যবান কোনটি?’ এমন প্রশ্নে সাধারণত সেলিব্রিটিরা পাশ কাটানোর মতো উত্তর দেন।
মান্নাদা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তার পর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘She, Yes she. She is the most precious gift from God. I would not have been here, if she is not in my life.
এই ঘটনা শুনে মনে পড়ল ‘A beautiful mind’ ছবির একটি দৃশ্য। নোবেল পুরস্কার নিতে এসে যখন জন ন্যাস প্রিয়তমা স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলছেন —‘ইউ আর দ্য অনলি রিজন আই অ্যাম, ইউ আর অল মাই রিজনস।’
এক সময় মান্নাদাকে নিয়ে বন্ধুরা কত মজাই না করেছে। এত বয়স হয়ে গেল একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারলি না। গীতিকার ভারত ব্যাস ছিলেন মান্নাদার বিশেষ বন্ধু। এই নিয়ে মান্নাদার সঙ্গে খুবই মজা করত। একদিন মজা করে একটা গানই লিখে ফেলল ‘বিন সাথি পার করো জীবন তো জানু …..।’ মান্নাদা তো জানেন না কাকে নিয়ে এই গান লেখা। সরল মনে বললেন ‘বা’ কথাগুলো তো খুব সুন্দর। আমিই গাইব এই গান। তখন ভারতজি বললেন ‘তুই ছাড়া আর কে গাইবে এই গান? এ তো তোর-ই কথা।’ শুনে মান্নাদা চুপ হয়ে গেলেন। আসলে যখন যা হওয়ার, তখনই তা হয়। সেই দিন এলো ১৯৪৮ সালে। মান্নাদা প্রেমে পড়লেন। সেই প্রেম পূর্ণতা পেলো। মানুষের কাছে একটা দৃষ্টান্ত রেখে গেল।
মুম্বইতে প্রবাসীদের একটা সংগঠন ছিল ‘ইন্ডিয়ান কালচার লিগ।’ তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান। সদস্যদের কিছু গান তৈরি করে দিতে হবে গাইবার জন্য। সুলোচনা কুমারন নামে একটি মালয়ালি মেয়ের সঙ্গে গাইতে হবে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’। গাইলেনও, কেউ বুঝতে পারল না সত্যি সত্যি কখন দু’জনের প্রাণের সঙ্গে প্রাণ বাঁধা হয়ে গেছে। তখন মান্নাদার একদিকে সুলোচনা—পৃথিবী অন্য দিকে।
ক’দিন বাদে মান্নাদা পড়লেন ভীষণ বিপদে। কলকাতায় যেতে হবে। বাড়ির সবাই একজন মানানসই পাত্রী দেখে রেখেছে। শিক্ষিতা, সুন্দরী সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। এই অবস্থায় সুলোচনার কথা বাড়িতে বলেন কী করে? মান্নাদার অত্যান্ত রক্ষণশীল পরিবার। গুরুজনেরা আছেন। সেই সময়ে একজন মালয়ালি মেয়েকে বিয়ের কথা ভাবাই যেতো না। কলকাতায় এলেন। কোনও উপায় নেই। যাঁর পায়ে প্রণাম করে সব দেবতাকে প্রণামের পুণ্য অর্জন করতেন, সেই মা-কে সব কিছু খুলে বললেন। মা, সুলোচনা ছাড়া আমি বাঁচব না। মা জানতেন তাঁর এই ছেলেটি একটু অন্য রকম। বললেন তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে বাবা। যদি মনে করিস এই বিয়েতে তুই সুখী হবি, আমার তাতে অমত নেই। মায়ের কথা শুনে মান্নাদার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। শুভ কাজটি সম্পন্ন হয়ে গেল। ১৯৫৩ সালে ১৮ ডিসেম্বর।
বৌদি ছিলেন মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজিতে এম এ এবং বি টি পাশ করে ওখানেই ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার অধ্যাপিকা। সময়টা ভাবুন। আজ থেকে ষাট বছরেরও বেশি সময় আগে। মান্নাদা তখনও সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হননি। কিন্তু তিনি জানতেন এই ছেলেটির মধ্যে প্রচণ্ড সম্ভাবনা। ঠিক মতো যদি নিজেকে তৈরি করতে পারে তবে একজন নামকরা গায়ক হবেই। বলতে গেলে মান্নাদার প্রতিভা বৌদিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। এতোটুকু সময় যেন নষ্ট না হয়। অমন সম্মানের চাকরি এক কথায় ছেড়ে দিলেন। পুরো সময় নিয়োজিত করলেন মান্নাদার জন্য। সংগীতের ইতিহাসে এই বিদুষী মহিলার আত্মত্যাগের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত। সংসারের সকল ঝক্কি, দুই মেয়েকে মানুষ করা, বৌদি একা হাতে তুলে নিলেন। বৌদির অনুপ্রেরণা— তোমাকে পারতেই হবে। বৌদির সমস্ত ত্যাগের মূল্য মান্নাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে। কথা রেখে।
ভালবাসা দিয়ে তো বটেই, বৌদির প্রতি এক অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা মান্নাদা বহন করেছেন সারা জীবন। আনন্দেও সুলোচনা, বিরহেও। বৌদির প্রতি ভালবাসার মধুর অনুভূতি নিয়ে গেয়েছেন সমস্ত রোমান্টিক গান। দাম্পত্যে বিষাদ কী কখনও হয়নি? রাগ করে দুই মেয়েকে নিয়ে বৌদি চলে গেলেন বাপের বাড়ি। তাই নিয়ে পুলকবাবু লিখলেন—‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারোনি। কী তার জবাব দেবে। যদি বলি আমি কি হেরেছি। তুমিও কী একটুও হারোনি’। এই গান শুনে আর কি অভিমান করে থাকা যায়? ফিরে এলেন বৌদি। মান্নাদাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
কলকাতায় একটা অনুষ্ঠানে মান্নাদা গান গাইতে ওঠার আগে একজন মিউজিশিয়ানের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা চেয়ে নিলেন (সাধারণত বাইরে মোবাইল ফোন নিয়ে বেরতেন না)। একটু লাজুক মুখে বললেন—‘গাইতে ওঠার আগে এক বার ওর সঙ্গে কথা বলেনি’। বৌদির প্রতি এই টান কোনও দিন, কোনও ক্ষণ, কোনও তিথি মানেনি।
এক বার আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একজন বিশিষ্ট মহিলা সংগীত পরিচালকের সঙ্গে মান্নাদার বাড়িতে গিয়েছি। একটা প্রোজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে। কথাবার্তা চলতে থাকে। ভদ্রমহিলাকে মান্নাদা যত কথা বলছেন, তার কথার উত্তর দিচ্ছেন, সবই আমার দিকে তাকিয়ে। আমরা যখন বাইরে এলাম, তিনি বললেন—‘তুমি একটা জিনিস খেয়াল করলে?’ আমি হ্যাঁ বলতে বললেন, ‘মান্নাদাকে তুমি তো এখন দেখছ, আমি দেখছি সেই কোন যুগ থেকে, মান্নাদা কোনও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত কথা বলতে পারেন না।’
নিজে যেমন প্রেমিক ছিলেন বলে অন্যের ভালবাসাকেও ভীষণ সম্মান করতেন, আপাতদৃষ্টিতে কিছু অসঙ্গতি থাকলেও। গুরু দত্ত ছিলেন মান্নাদার বিশেষ বন্ধু। প্রথম জীবনে দু’জন এক সঙ্গে অনেক স্ট্রাগল করেছেন। থেকেছেনও কিছু সময় এক সঙ্গে। মান্নাদা বরাবরই খুবই বিচক্ষণ। অন্যদের থেকে ম্যাচিউরিটি অনেক বেশি। নানা ব্যাপারে গুরু দত্ত মান্নাদার পরামর্শ নিতেন। একদিন একান্তে মান্নাদাকে বললেন মনের কথা। তাঁর সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানুষের জীবন। গুরু প্রেমে পড়েছেন। মান্নাদার পরামর্শ চাই। মেয়েটিও মান্নাদার ভীষণ চেনা। যেমন রূপ, তেমন তাঁর গানের প্রতিভা। গীতা দত্ত। মান্নাদা ভাবার জন্য একটু সময় নিলেন। বিয়ে মানে দুটি সমমনস্ক মানুষের চিরকালীন যোগসূত্র রচনা। এই সমমানসিকতা কেমন? গুরু দত্ত একজন অতি শিক্ষিত ইনটেলেকচুয়াল ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষাটাকে বুঝতে না পারলে মুশকিল। তাঁর পার্টনারের যত গুণই থাকুক না কেন? একটা ম্যাচিং ম্যাচিউরিটি থাকা দরকার। মান্নাদার মনে একটা ক্ষণিক সংশয় এলো। আকারে ইঙ্গিতে গুরুকে সে কথা বোঝাতেও চাইলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন, অত্যন্ত ইমোশনাল গুরুর মন-প্রাণ ছেয়ে আছে গীতা।
ভবিষ্যতের ভাবনার জন্য বর্তমানের ভালবাসাকে অস্বীকার করবেন কী করে? গুরুর পিঠে হাত রেখে মান্নাদা তাই বললেন—‘তোমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা কোরো না। আমার শুভেচ্ছা রইলো।’ ভাগ্যের এমন পরিহাস, পরবর্তী কালে সে-বিবাহ সুখের হয়নি। মান্নাদা খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। বলতেন, ‘কেন যে ঈশ্বর এমন করেন।’
প্রায় এমনটাই ঘটেছিল রাহুল দেববর্মন-আশা ভোঁসলের ক্ষেত্রেও। তবে পুরোটা নয়। দু’জনেই মনস্থির করেছেন বিয়ে করবেন। কার অ্যাডভাইস নেওয়া উচিত। কেন মান্নাদা। দু’জনেই মান্নাদাকে অভিভাবক বলে মানতেন। লতাজি ‘লতা’ বলে ডাকলেও আশাজিকে ডাকতেন ‘আশাতাঈ’ বলে। মরাঠিতে ‘তাঈ’ মানে বোন। আশাজি যখন গণপত ভোঁসলেকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন বাড়ির কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। কোনও সম্পর্ক রাখেনি। আশাজির ব্যক্তিগত জীবন এমন সংকটে, গানের কেরিয়ারে সেটল হওয়ার জন্যই সেই সময়ে প্রবল সংগ্রাম করছেন। তখনও পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন মান্নাদা। বড়দাদার মতো। তাঁকে গাইড করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন।
অন্য দিকে রাহুলদেবও তাঁর ভীষণ প্রিয়। যদিও কাকা-ভাইপোর মতো সম্পর্ক। রাহুল দেব ডাকতেন ‘মান্নাদা’ বলে। কখনও কখনও দু’জনে একেবারে বন্ধুর মতো। বলতে দ্বিধা নেই বহু বার মান্নাদা বলেছেন—‘ট্যালেন্টের কথাই যদি বলতে হয়, শচীনদার থেকে পঞ্চম অনেক বেশি ট্যালেন্টেড। কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, রিদিম নিয়ে, সুর নিয়ে।’ দু’জনেই মান্নাদাকে বললেন তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা। অনেক কিছুতেই ফারাক—বিশেষ করে বয়সের, আশাজির সন্তানেরা তখন সব বড় বড়। মান্নাদা অভয় দিলেন। এগিয়ে যাও। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
যিনি ভেবেছেন, গেয়েছেন, ‘শুধু একদিন ভালবাসা, মৃত্যু যে তার পর/তাও যদি পাই/আমি তাই চাই। চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।’ ভালবাসার মন্দিরে তিনিই ছিলেন একনিষ্ঠ পূজারি—মান্না দে।
বিএসডি/এমএম