সম্প্রতি ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা সরবরাহে অনিশ্চয়তা এবং চলমান টিকাদান কার্যক্রম গতিশীল রাখতে সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর দ্রুততম সময়ে চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন-এর জরুরি অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশ আগামী ১২ মে-এর মধ্যে পাঁচ লাখ ডোজ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছে। এ কারণে সাধারণ জনগণের মাঝে ভ্যাক্সিনটির উৎপাদন পদ্ধতি, কার্যকারিতা ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফলাফলসহ বিস্তারিত বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য পরিবেশন জরুরি।
ভ্যাকসিনটি কতটা কার্যকর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, একাধিক দেশে চালানো ট্রায়ালে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির দুই ডোজ দেওয়ার পর ৭৮.১ শতাংশ কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা ইতঃপূর্বে চীনা সংস্থাটির দাবিকৃত ৭৯.৩৪ শতাংশ কার্যকারিতা হারের চেয়ে কিছুটা কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী ভ্যাকসিনটি হাসপাতালে ভর্তি রোধে ৭৮.৭ শতাংশ কার্যকর। চীন, বাহরাইন, মিশর, জর্দান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ট্রায়ালের ফলাফল পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ফলাফল জানায়, তবে ভ্যাকসিনটি অনুমোদনের বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত জানায়নি।
এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত সর্বপ্রথম সরকারিভাবে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করে, যদিও এ সম্পর্কিত ফলাফল এখনো কোনো গবেষণাপত্রে প্রকাশ হয়নি। আবুধাবি পাবলিক হেলথ সেন্টারের করা এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, সিনোফার্মের ভ্যাকসিন গ্রহণের পর আরব আমিরাতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ট্রায়ালে একত্রিশ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক (১৮-৬০ বছর বয়সি) সিনোফার্মের টিকাটি গ্রহণ করেছেন এবং ৯৯ ভাগ গ্রহীতার শরীরে টিকাটি কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়তে সক্ষম হয়েছে। উক্ত রোগীদের কারও ক্ষেত্রেই মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা সে বিষয়ে তারা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতির পর কয়েকটি বিদেশি মিডিয়া যেমন রয়টার্স সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আত্মবিশ্বাস কম হওয়ার কারণ হলো পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেওয়া প্রবীণদের সংখ্যা খুব কম ছিল। তারা জোর দিয়েছিলেন যে সিনোফর্মের ভ্যাকসিনটি এখনো ১৮-৫৯ বছর বয়সি গ্রুপে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং ১৮-৫৯ বয়সিদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সিনোফার্মের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
সিনোফার্ম ভ্যাকসিন কী এবং এটি কিভাবে মানবদেহে কাজ করে
সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি- সিওআরভি (BBIBP-CorV) মূলত একটি নিষ্ক্রিয় বা ইনেক্টিভেটেড ভ্যাক্সিন যা ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইনেক্টিভেটেড পোলিও বা র্যাবিস ভ্যাকসিনের অনুরূপ বহুল প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণে তৈরি।
করোনাভাইরাসকে কেমিক্যালের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে ভ্যাকসিন হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। চীনের আরেকটি ভ্যাকসিন সিনোভ্যাক, ভারতের কোভ্যাক্সিন এ পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রস্তুত করা হয়েছে। যেহেতু ভ্যাকসিনটি নিষ্ক্রিয় বা ইনেক্টিভেটেড ভাইরাস থেকে তৈরি তাই মানব দেহে আশানুরূপ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আটাশ দিন ব্যবধানে দুই ডোজ টিকা গ্রহণ আবশ্যক। টিকাটি সাধারণত বাহুর মাংসপেশিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
কোন কোন দেশ ভ্যাকসিনটি অনুমোদন দিয়েছে
ইতোমধ্যে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের কমপক্ষে ৪০টি দেশ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছে। শ্রীলংকা, ফিলিস্তিন, মালদ্বীপ, নেপাল ও পাকিস্তান সম্প্রতি ভ্যাকসিন অনুমোদন চূড়ান্ত করেছে। এ ছারাও বিশ্বের ৭টি দেশে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে।
চীন ইতোমধ্যে বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বিবিআইবিপি- সিওআরভি (BBIBP-CorV) টিকাটির কয়েক মিলিয়ন ডোজ চীনের ব্যবহারের জন্য ও অনুমোদনকারী দেশগুলোতে রপ্তানির জন্য মজুত রয়েছে।
সিনোফার্ম টিকার দাম
বিশ্বের কোনো টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিই এখনো প্রতি ইউনিট ভ্যাকসিনের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করেনি। সিনোফার্ম টিকার দুই ডোজের জন্য ৬০ থেকে ১৫০ ডলারের খরচ হতে পারে, যা মূল্যমান বিবেচনায় অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় কিছুটা বেশি। ফেব্রুয়ারিতে সেনেগাল সিনোফার্মের দুই লাখ ডোজ টিকার জন্য ৩৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের কিছু বেশি পরিশোধ করেছে, সে ক্ষেত্রে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়েছে প্রায় ১৯ ডলার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর
ফাইজার ও মডারনা ভ্যাকসিনের তুলনায় সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (কোল্ড চেইন সিস্টেম) অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ টিকাটির সংরক্ষণ, পরিবহণ এবং বিপণন প্রক্রিয়া অধিকতর উপযোগী।
যেহেতু সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি- সিওআরভি ভ্যাকসিনটি ইনেক্টিভেটেড বা ডেড ভাইরাস থেকে তৈরি, এটি সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজের স্বাভাবিক তাপমাত্রা দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৬-৩৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) যথেষ্ট। বাংলাদেশে বিদ্যমান কোল্ড চেইনের সক্ষমতা এবং পরিবহন ও বণ্টন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি যথোপযোগী। সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি বলে সহজেই আমাদের দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। চীন ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এতে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবে। ফলে অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে বিপুল জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব হবে এবং বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত প্রতিরক্ষা (হার্ড ইমিউনিটি) অর্জন করতে পারবে।
ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ট্রায়ালের ফলাফল এখনো কোনো প্রভাবশালী মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়নি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।
লেখক : ডা. রোজেন- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক, কানাডা;
ডা. আয়শা- ব্যাক্টেরিওলজিস্ট, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা