নিজস্ব প্রতিবেদক
টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহফুজকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিনতাই চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, রাফসান জানি রাহাত (২৮), রাশেদুল ইসলাম (২০), কাওছার আহম্মেদ পলাশ (২৩) ও রাকিব ইসলাম (২৬)।
রোববার (১৩ জুলাই) উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মেজর মুহাম্মদ আহনাফ রাসিফ বিন হালিম বলেন, আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যায়নরত হাতেম আলী কলেজের ছাত্র মো. মাহফুজুর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে তার পায়ে রক্তাক্ত জখম হয় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কিছু সময় পর তার নিথর মরদেহ আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন বিআরটির একটি নির্মাণাধীন স্থানে পাওয়া যায়।
ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর দুর্বৃত্তরা অতি দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনা অনুসন্ধানে কোনো ক্লু ছাড়াই র্যাবের ছায়া তদন্ত শুরু হয়। ছায়া তদন্তের এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীর অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সেটটি হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২ ঘণ্টা পর শনাক্ত করা যায়।
এর সূত্র ধরে র্যাব-১ এর একটি দল মোবাইল ফোনে গ্রাহককে দ্রুত সময়ে শনাক্ত করে নজরদারিতে আনে। মোবাইলের গ্রাহককে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি জানান যে ভুক্তভোগীর মোবাইল সেটটি টঙ্গীর মাজার বস্তির এক চোরাই মোবাইল ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ক্রয় করেন।
অনুসন্ধানে র্যাব-১ এর দলটি মোবাইলের গ্রাহককে বিভিন্ন সন্দেহভাজন চোরাই মোবাইল চক্রের ছবি দেখান হয়। গ্রাহক তৎক্ষণাৎ মোবাইল বিক্রেতা রাকিবকে শনাক্ত করে। পরে র্যাবের দলটি তাকে গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে।
মোবাইল বিক্রেতা রাকিব একজন প্রাক্তন মাদক ব্যবসায়ী। তিনি বর্তমানে ছিনতাইকারীদের ব্যবহার করে কম মূল্যে মোবাইল সংগ্রহ করেন এবং লাভজনক মূল্যে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে বিক্রয় করেন। একই সঙ্গে ছিনতাইকারীরা তার নিকট হতে সুইচ গিয়ার এবং অন্যান্য ধারালো সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। চোরাই মোবাইল বিক্রেতা রাকিবের কাছে একটি ছিনতাই চক্র মোট ৩টি মোবাইল সেট বিক্রয় করেন।
ভুক্তভোগীর বোন জামাই মো. জসিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে টঙ্গী পশ্চিম থানায় গত ১১ জুলাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরপর গতকাল শনিবার (১২ জুলাই) ছিনতাইকারী চক্র শনাক্ত করার জন্য র্যাব আবার অভিযান চালায় এবং রাকিবের তথ্য দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাফসান জানি রাহাত, রাশেদুল ইসলাম, কাওছার আহম্মেদ পলাশদের টঙ্গীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযানে প্রথমে কাওছার আহম্মেদ পলাশকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার পলাশের তথ্য অনুযায়ী ছুরি ব্যাবহারকারী ছিনতাইকারী রাশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ছাত্র মাহফুজকে গুরুতর জখমের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন এবং তাদের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ছিনতাইকারীর সন্ধান দেন। একই সঙ্গে ছিনতাইয়ের সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল চালক রাহাতের সন্ধান দেন। চালক রাহাতকেও একইদিনে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মাধ্যমেই ১টি ছিনতাই চক্র সম্পূর্ণ গ্রেপ্তার হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা পেশাদার ছিনতাইকারী এবং একই দিনে তারা রাজধানীর হাউজ বিল্ডিং এবং কুর্মিটোলা এলাকায় আরো দুটি মোবাইল ফোন ছিনতাই করেন।
ক্লুলেস মাহফুজ হত্যার ব্যাপারে তারা জানান, ছিনতাই করার সময় তারা সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেন। একটি চক্রের মধ্যে পলাশ মূলত বিভিন্ন ভিকটিমের ব্যক্তিগত মোবাইল মানিব্যাগ ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে সাগর ধারালো অস্ত্র দ্বারা ভুক্তভোগীকে ভয় দেখান এবং ভুক্তভোগী তাদের কথা না শুনলে শরীরের আঘাত করার মাধ্যমে তার নিকট থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন।
ছিনতাই করার পূর্বে তারা সাধারণত মাদকসেবন করে আসেন এবং চোরাই মোবাইল বিক্রেতা রাকিবের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র সংগ্রহ করেন।
ছিনতাইকারীরা স্বীকার করেন যে দুটি স্থানে তাদের সঙ্গে ভিকটিমের হাতাহাতি হয়, যার কারণে সে দ্রুত তার ধারালো অস্ত্রটি ব্যবহার করেন। ছিনতাই করার পরে তারা ৩টি মোবাইল ঘটনার প্রায় ২ ঘণ্টা পর রাকিবের কাছে হস্তান্তর করেন।
চোরাই মোবাইল ফোন বিক্রেতা রাকিব জানান, মোবাইলটি হস্তান্তর করার পরে তিনি পলাশের হাতে রক্ত দেখতে পান যা তিনি ছিনতাই করার পর ধুয়ে ফেলেন। একই সঙ্গে তিনি জানান যে পুরো চক্রটি এক ড্রাম পানি ব্যবহার করে গোপনে নিজেদের পরিষ্কার করে নেয়।
রাকিবের দেওয়া তথ্য ছিনতাইকারী পলাশ স্বীকার করলেও তিনি দাবি করেন, হত্যার উদ্দেশ্যে তারা কাউকে সাধারণত আঘাত করেনি। অন্যদিকে ছুরি ব্যবহারকারী রাশেদ অত্যন্ত চালাকির সঙ্গে ঘটনাটি এড়িয়ে যান এবং ঘটনাস্থলে তার অনুপস্থিতির কথা বলেন। তাদের জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ক্রাইম টাইম এবং তাদের উপস্থিতি যাচাই করা হয়। যাচাইয়ের পরে দেখা যায় যে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে তারা মোটরসাইকেল চালকসহ ১১টা ৩৭ মিনিট থেকে ওই স্থানে উপস্থিত ছিল এবং এরপর মাত্র ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের মধ্যেই তারা ঘটনাটি শেষ করে দ্রুত পালিয়ে যায়।
সার্বিক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর মোবাইল ফোন চোর রাকিব একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। ছিনতাই চক্রের ছিনতাইকারীরা তাদের মোবাইলের বিনিময়ে ওই দিন রাকিবের কাছ থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করেননি। তারা মোবাইল বিক্রয় করতে আসার পরে রাকিব তাদের জানান যে পুলিশ, ছাত্র মাহফুজ হত্যার দায়ে ছিনতাইকারীদের সন্দেহ করছেন। এ কথা শোনার পরে রাশেদ খুব দ্রত ভিকটিমের মোবাইল সেটটি রাকিবকে হস্তান্তর করেন এবং অর্থ আদায় না করে ওই দিনই আত্মগোপনে থাকেন। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।