শিবু দাশ সুমিত
পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘ অনেক দিন ধরেই বেশ কিছু কথা বলে আসছে। জাতিসংঘ জানাচ্ছে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে সাগর-পৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। তাদের মারফতে আরো জানা যায় জলবায়ুর এই পরিবর্তন যদি সমগতিতে চলতে থাকে তবে ২১০০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্টের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে ১.১ মিটারের মত।
সমুদ্র পৃষ্ঠের এই উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য মানুষের দীর্ঘদিনের চালানো অযাচিত কর্মকাণ্ডই অনেকাংশেই দায়ী। অধিক হারে বৃক্ষ নিধন, জলাভূমি ভরাট করে গৃহ নির্মাণ, কলকারখানা থেকে নদী-পুকুড়-খাল-বিলে অপরিমিতভাবে বর্জ্য নিক্ষেপ, যত্রতত্র পলিথিনের ব্যবহার যা সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতার, শস্য ক্ষেতে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার যা কিনা অনেক উপকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে একটি। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল (IPCC বা Intergovernmental Panel on Climate Change) বলছে, এ শতাব্দীর মাঝামাঝি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ১ মিটার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল। এর পর ধীরে ধীরে তা গ্রাস করবে অন্য অঞ্চলকেও।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমুদ্রগর্ভ যদি ৫ ফুট বা তার কাছাকাছি উঁচু হয়, তবে বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে এবং তা শুরু হতে পারে নিম্নাঞ্চল থেকে। ফেলে আসা কয়েক বছরের হিসাব বলছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলের কিছু এলাকায় এরই মধ্যে এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢাল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বিধৌত সুন্দরবন মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে এর অনেকাংশ। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের ভেতরে অবস্থিত সুপেয় পানির কিছু উৎসে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়েছে যার প্রভাবে সেখানে যেসব আবাদি জমি ছিল তাতে ফসল উৎপাদন আগের চেয়ে অনেকটাই মিয়ম্রাণ হয়ে গেছে।
জীবজন্তুর জন্য যা অশনিসংকেত। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে সুন্দরবন অনেকদিন ধরেই আমাদের সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। ১৯৭০ এর “দ্যা গ্রেট ভোলা সাইক্লোন” ১৯৯১ সালে আঘাত হানা মেরি অ্যান এবং সাম্প্রতিক কালের সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, রোয়ানু, মোরা, ফণী, বুলবুল, আম্ফান থেকে প্রতিনিয়ত এই ভূখণ্ডকে বিপদমুক্ত রেখেছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার বিস্ময় সুন্দরবন! সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলার কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে করে মাটি তার স্বাভাবিক উর্বরতা হারাচ্ছে এবং খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। বিঘ্নিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। শুধুমাত্র নিম্নাঞ্চলই নয়, রাজধানী ঢাকাও আশঙ্কামুক্ত নয়।
ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (WWF) মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান German Watch তাদের ২০১৯ সালে প্রকাশিত Global Climate Risk Index এর এক প্রতিবেদনে জানায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাতে শীর্ষ ১০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম।পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ। জলবায়ুর পরিবর্তন জাতীয় সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিরোধেরও উদ্ভব ঘটাবে। বিশ্বের নানা প্রান্তের ছোট ছোট উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। জলাভূমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় অনেক দেশের ভূখণ্ডের আকার ছোট হয়ে যাবে। ডুবে যাওয়ার আগে এসব দেশের অস্তিত্ব এমনিতেই হুমকিতে পড়বে, কেননা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে কোনো দ্বীপ ডুবে যাওয়ার আগেই সেটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সমুদ্রসীমা নিয়ে দেশে দেশে বিরোধ দেখা দেবে।
বর্তমান বেইজলাইন ও শোরলাইনে প্রায় নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তন আসবে। এসব ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তনেই জাতিসংঘের কনভেনশন্স অন দ্য ল’ অব দ্য সি ( UNCLOS ) প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হবে, ফলে সমুদ্রসীমা ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে প্রবেশাধিকার নিয়ে বিরোধ দেখা দেবে। এতে আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বিনষ্ট হবে। শান্তি নিশ্চিত করা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে জ্বালানি অবকাঠামো ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।আমরা জানি পারমানবিক চুল্লিতে সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহের প্রয়োজন আছে বলেই এসব চুল্লি সাধারণত সমুদ্রের কাছাকাছি স্থাপন করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি ঢুকে তা ডুবে যেতে পারে। চুল্লির কার্যক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা জাপানের ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নাম উল্লেখ করতে পারি। যেটি ২০১১ সালের সুনামিতে ভেসে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে চুল্লির সাধারণ কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্র ও বায়ুতে ক্ষতিকর বিকিরণ বা রেডিয়েশন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোন বিরল ঘটনা। আর বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ডাইনোসরের চেহারা ভেসে ওঠে। দ্রুত পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলশ্রুতিতে অনেক প্রাণী সম্পূর্ণ নতুন অবস্থানের সাথে অভিযোজিত হতে না পেরে বিলুপ্তি হয়ে গেছে যার মধ্যে রয়েছে ডাইনোসর, লাল মাথাওয়ালা বানর, ক্যারিবিয়ান সিল, ডোডো, অ্যালাবামা পিগটো, সাদা লেজওয়ালা ঈগলসহ আরো অসংখ্য নাম না জানা প্রজাতি। প্রাণীবৈচিত্র রক্ষায় কাজ করা বেসরকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের এই ব্লু প্ল্যানেট থেকে!
জাতিসংঘের তথ্য মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০টি প্রজাতির বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি বলে জানা যায়৷ বিপন্ন প্রাণীসমূহের মাঝে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হাতি, অজগর সাপ, কুমির, ঘড়িয়াল ইত্যাদি৷ বিগত শতাব্দীতেই বাংলাদেশে ১৯টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ যার মাঝে অন্যতম হলো গন্ডার, বুনো মোষ, কালো হাঁস, নীলগাই, রাজশকুন ইত্যাদি৷ কেউ কেউ মন্তব্য করেন এই জনপদে ২৭টি বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে ও ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ এই অঞ্চলের মিঠা পানিতে ২৬০ প্রজাতির স্থানীয় মাছ, ৩১ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি এবং সমুদ্রে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় ও কমপক্ষে ১৬ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি পাওয়া যায়৷ দেশে প্রাপ্ত ৪৫০ প্রজাতির শামুক ঝিনুকের মাঝে ৩০০টি উপকূল এলাকায় পাওয়া যায়৷ যার অধিকাংশ প্রজাতিই আজ বিলুপ্ত।
আজ থেকে এক বা দুই দশক আগেও যেসব মাছ পাওয়া যেত যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ভাঙনা, চিতল, ছোট পুতনি, খাটা চেং, কালজাটা, চেলা, বাগ, ধুরয়া, নালাছাতা, বাজয়ি, নাড়ালি, পিঠকাটা, কোনা টেংরা, কাজলী, বোম, ছুরি, গাং, বাঁশ পাতারি, বাকল, চাঁদা, রাজ, কলই, সরপুটি, কালুন, মলা, খইলশা, চেউয়া, বাইম এবং বোটি৷ কিন্তু বর্তমানে জীববৈচিত্র্য পরিবর্তনের ফলস্বরুপ এসব মাছ আর দেখা যায় না।
ইউনিসেফ মনে করে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামাল দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত না হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ বড় ধরনের দুর্যোগে জীবনরক্ষা, উন্নয়ন, অংশগ্রহণ এবং শিশুর সুরক্ষা উন্নততর করার প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্ভাব্য নাজুক পরিস্থিতি সামালে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। দুর্যোগে গতানুগতিক জরুরি ‘সাড়া ও ত্রাণ’ ভিত্তিক কার্যক্রম থেকে দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনের আরও সমন্বিত ও টেকসই কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অ্যাক্টের আওতায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের একযোগে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই পরিবেশের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জ্বালানি চাহিদা পূরণের নিমিত্তে সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ ও সামাজিক বনায়ন করতে হবে।
গর্ব করার মত একটি ব্যাপার হলো পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সৌর হোম সিস্টেম ব্যবহারকারী দেশ। ৫.৫ মিলিয়ন সৌর হোম সিস্টেমের মাধ্যমে দেশের ১৩% জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা নিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ এর ১০% বিদ্যুৎ সৌর বিদ্যুৎ এর মাধ্যমে সরবরাহ করছে। যেটি ২০৪১ সালের মধ্যে ১৭% এ উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীকে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে বর্তমানে বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩.৫০ শতাংশে যা কিনা ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৯.৫০ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লক্ষ বীরের স্মরণে সম্প্রতি রোপণ করা হয়েছে ৩০ লক্ষ গাছের চারা। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার যেসব সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে তার স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ তাদের পরিবেশ বিষয়ক সর্ব্বোচ্চ সম্মাননা ” Champions of the Earth ” পুরস্কারে ভূষিত করে। পানি দূষণের জন্য দায়ী তরল বর্জ্য উৎপন্নকারী শিল্প কলকারখানায় “তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার” (EFT-Effluent Treatment Plant) স্থাপন বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।
সম্প্রতি পানি দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘জীবনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। পানি ব্যবস্থাপনার ওপর একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আশা করছি- আগামীতে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম হবে।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পানির সঙ্গে জলবায়ুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। গৃহস্থালি, কল-কারখানা, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পানির ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি এবং শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টির কারণে আমাদের দেশের প্রাণীকূল ও জীববৈচিত্র্য তথা প্রকৃতি প্রতিনিয়তই হুমকির মুখে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা যেন কোনোভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত না করে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে।’
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘ রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে দেশ তা থেকে উত্তরণের জন্য নেয়া হয়েছে ১০০ বছর মেয়াদী ডেল্টা প্ল্যান যাতে খরচ হবে মোট দেশজ প্রবৃদ্ধির ২.৫%। আশা করা যাচ্ছে তিনটি ধাপে এর কাজ বাস্তবায়িত হবে।প্রথম ধাপ হবে ২০৩১ সালের মধ্যে,দ্বিতীয় ধাপ হবে ২০৫০ সালের মধ্যে আর সর্বশেষ বা চূড়ান্ত ধাপের কাজ শেষ হবে ২১০০ সালে। এই শত বছরব্যাপী পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যা, নদীভাঙন, নদী শাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামের পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে করে আমাদের অনেক অর্থের সাশ্রয় হবার পাশাপাশি জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকেও কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, ভারী বর্ষণ, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙনসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশই প্রথম নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯-২০২১ সালের জন্য ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ‘Climate Change Trust Fund’ নামক একটি ফান্ড গঠন করে যার মূল উদ্দেশ্যই হলো জলবায়ুগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট দুর্যোগ সামাল দেয়া। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছে ‘ Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan 2009।’ এর মাধ্যমে ৪৪০টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, ২৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ ৬০টি উপজেলায় ১০০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৩৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছে, পর্যায়ক্রমে আরো ১৬৫০টি নির্মাণ করা হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ‘Flood Action Plan’ এর আওতায় নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, নদীকে অবৈধ দখলের হাত থেকে উদ্ধার করা, উপকূলীয় অঞ্চলে বেরিবাঁধ নির্মাণসহ আরো ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। বায়ু দূষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন,২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। গ্লোবাল সেন্টার অন এডাপটেশন (জিসিএ)’র দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক অফিস উদ্বোধনের প্রাক্কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন দক্ষিণ এশিয়া ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, আকস্মিক বড় ধরনের বন্যা, ভূমিধস ও তুষারধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। পরিস্থিতি এতোটাই শোচনীয় যে, তাপমাত্রা যদি আর মাত্র ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসও বৃদ্ধি পায়, তবে বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। তিনি বলেন, ‘এছাড়া আমাদের নারী, শিশু, বয়স্ক মানুষের ঝুঁকির কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃস্বরণ ও অন্যান্য পরিবেশ বিপন্নতা থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০০৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজি এন্ড একশন প্লানের আওতায় বিভিন্ন মিটিগেশন ও এডাপটেশন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকার কর্তৃক জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ জারি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করি এবং ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে এ পর্যন্ত ৪৩ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর জিডিপির এক শতাংশ এডাপটেশনে ব্যয় করে আসছে, যার পরিমাণ বছরে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো: শাহাব উদ্দিন বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব অনাহুত সমস্যার উদ্ভব ঘটবে তা যদি শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা না যায় তবে আমাদের সকল অর্জন বৃথা যাবে। এই ঝুঁকি থেকে উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বকে হাতে হাত রেখে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
একসাথে লড়বো, একসাথে গড়বো
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিমুক্ত পৃথিবী গড়বো।
লেখক: শিবু দাশ সুমিত
নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি)
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল।