নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ সম্প্রতি দেওয়া বিবৃতিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ সম্পর্কে কিছু অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন। তার বিবৃতিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিষয়েও অসত্য, মনগড়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্য রয়েছে।
রোববার (২ মার্চ) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন অনুষ্ঠানের মধ্যে বক্তব্য প্রদানের মধ্যে শিল্পকলা একাডেমির সচিবের নিকট লিখিত পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দাখিলকৃত পদত্যাগ পত্রে তিনি কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও পরবর্তীতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিছু কারণ উল্লেখ করেন।
তার উল্লিখিত কারণসমূহের মধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের প্রতি কিছু অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিষয়েও অসত্য, মনগড়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্য রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের বহুত্ববাদী ও ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক বয়ান রচনা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ কর্তৃক উত্থাপিত অসত্য অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
একটি ভিডিও নির্মাণের বিষয়ে চিঠিপত্র ছাড়া টাকা প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের বক্তব্য বা অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য ও বানানো উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২০-২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের পক্ষে অনুষ্ঠানে মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস সংরক্ষণে বাংলাদেশের অবদান তুলে ধরে বিশেষভাবে নির্মিত একটি ১৫ মিনিটের ভিডিও এবং একটি লাইভ প্রোগ্রাম উপস্থাপন করা হয়। ভিডিওটি নির্মাণের জন্য গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে একটি পত্র পাঠানো হয়। পত্রের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের ৩৮ কোডের ‘সাংস্কৃতিক মঞ্জুরি- ৩৮২১১১৫’ খাত থেকে বর্ণিত খরচের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হবে। উন্নত কারিগরি সহায়তা এবং সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে ভিডিওটি নির্মাণের জন্য নিয়ম অনুযায়ী অগ্রিম কিছু অর্থ নির্মাতাকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সম্পূর্ণ অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বাজেট বরাদ্দ না দিলে অর্থ দেওয়া হবে না বলে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুরোধকে নাকচ করেন।
অথচ মহাপরিচালকের পূর্বে সাধু মেলা অয়োজনের জন্য শুধুমাত্র উপদেষ্টার মৌখিক কথায় প্রায় ৩৩ লাখ টাকার প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে এই বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সাধারণত জরুরি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় তার দপ্তর সংস্থাগুলোর এরকমভাবে কাজ এগিয়ে নেয়।
কিন্তু এবার আগেই পত্র দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য উপদেষ্টা, ইউনেস্কো সদর দপ্তর, বাংলাদেশ দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভিডিও নির্মাতা, শিল্পকলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক অসৌজন্যমূলক ভাবে ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান।
পূর্বে এ ভিডিও নির্মাণের জন্য যথোপযুক্ত পত্র পাঠানো হলেও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের প্রতি সম্মান ও তার একগুয়েমির জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি পুনরায় বাজেট বরাদ্দের বিষয় উল্লেখপূর্বক করে পত্র পাঠানো হয়। প্যারিসস্থ ইউনেস্কো সদর দফতরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রায় ২০ দিন আগে মন্ত্রণালয় থেকে পত্র পাঠানো এবং ১০ দিন আগে বাজেট বরাদ্দ প্রদান সংক্রান্ত পত্র দেওয়ার পরও চিঠি ছাড়া টাকা দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে চাপ দেওয়ার বক্তব্য দেওয়া হয়। এটা শুধু অসত্যই নয়, ব্যক্তিগত আক্রোশের বহি:প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এমনভাবে বিষয়টির অবতারণা করেছেন যে, প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য কোনো অনৈতিক টাকা দাবি করেছেন। বাংলাদেশের সম্মান বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা, শত শত শহীদদের কথা ইউনেস্কো সদর দপ্তরের উপস্থাপন করার জন্য যেখানে শিল্পকলা একাডেমির আরো ঘনিষ্ঠ থেকে সাহায্য করার কথা, সেখানে শিল্পকলার মহাপরিচালক মহোদয়ের এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মিথ্যাচার জুলাই গণঅভ্যুত্থান, ২০২৪ এর শহীদদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল।’
শিল্পকলা একাডেমির কাজে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে বলা হয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমির কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেনি। মন্ত্রণালয় একাডেমির কোনো কাজ বন্ধ করতে বলেছে এরকম কোনো নজির নেই। বরং সবসময় শিল্পকলার কাজকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোন কোন জায়গায় যখন বাউলদের প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমিকে বাউলদের জন্য শিডিউলকৃত সাধু মেলার সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পরামর্শ দেয়। এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।
এছাড়া ‘রিমেম্বারিং জুলাই রেভ্যুলেশন’ নামে ৮ বিভাগে প্রোডাকশন ওরিয়েন্টেড ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে একদল বেসরকারি বিশেষজ্ঞ টিম এজন্য কাজ করছে। এসব কাজে মন্ত্রণালয় সার্বিকভাবে সহযোগিতা ও সমন্বয় করছে। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে ৮ টি নতুন থিয়েটার ও একটি গেরিলা/ ইনভিজিবল থিয়েটার নির্মাণের বিষয়েও মন্ত্রণালয় থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচিতে শিল্পকলা একাডেমির অনুরোধে মন্ত্রণালয় থেকে সাধারণ বাজেটের বাইরেও বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং শিল্পকলা একাডেমিকে আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান ছাড়া কোনোরকম হস্তক্ষেপের কোনো নজির নেই। তাই যা তিনি বলেছেন তা অসত্য, তার মনগড়া।
বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে তার অমূলক অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, জুলাই বিপ্লবের পর শিল্পকলা একাডেমির নিয়মিত বাজেট বরাদ্দের বাইরেও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ব্যক্তিগত আগ্রহে সাধুমেলা আয়োজন, জুলাই বিপ্লবের উপর বিশেষ নাটক প্রযোজনা, মনীষী স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কোনো আর্থিক বছরে বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি নিতান্তই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দের মিটিং-এ রুটিন দায়িত্ব অনুযায়ী নেগোসিয়েশনের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সকল দপ্তর/ সংস্থার প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলার ভঙ্গুর শিল্পকলা একাডেমি ভবন মেরামত, সংস্কারসহ সর্বমোট ২০০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। অর্থ সচিব মিটিংয়ের প্রথমইে সব দপ্তর/সংস্থা প্রধানের উদ্দেশ্যে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দা ও সীমাবদ্ধতার জন্য বাজেট কিছুটা কাটছাঁট করা হবে তবে শিল্পকলা একাডেমির বিষয়ে বলা হয়েছে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা হলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের শিল্পকলা একাডেমির জন্য চলতি বছরের চেয়েও বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে অবহিত করা হয়। এমনকি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও অর্থ বরাদ্দ করা হবে বলে নিশ্চিত হয়েছে। তাই অপর্যাপ্ত বাজেট বিষয়ে অভিযোগ নিতান্তই অমূলক ও প্রশাসনিক অদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের ফাইনাল রিহার্সাল অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত ও আবহ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে রিহার্সালে আসতে না দিয়ে মিটিংয়ের নামে আটকিয়ে রাখেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। যে মিটিং তিনি সকাল বেলা বা পরদিন বিকেলে আয়োজন করতে পারতেন। একই অনুষ্ঠানের পদক বিতরণে জাতীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণকারী একজন সঙ্গীত শিল্পীকে শুনানির নামে অংশ নিতে দেননি। সংশ্লিষ্ট শিল্পী একুশে পদকের অনুষ্ঠানে অংশ নিবেন বলে শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে, তিনি কোনোভাবেই তাতে রাজি হননি। বরং তিনি তাকে বিষোদগার করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১২৫তম পরিষদ সভার কার্যবিবরণী অনুমোদনের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কালক্ষেপণ প্রসঙ্গে মহাপরিচালকের অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি পরদিন যোগদান করেন। তাঁকে সচিব পদ মর্যাদা প্রদান করা হয় ২১ নভেম্বর। এর প্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৫ ডিসেম্বর তার চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে প্রত্যয়ন করে পত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠান ৮ ডিসেম্বর। উপদেষ্টা কর্তৃক তারিখ ও সময় নির্ধারণ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ১২৫তম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে। ওই সভার কার্যবিবরণী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় ২৩ ডিসেম্বর। কার্যবিবরণীর ক্রমিক নম্বর ১, ৫, ৬, ১১, ১২ ও ১৩ এর বিষয়ে অসম্পূর্ণ তথ্যসহ বিদ্যমান আইনের সাথে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত ছিল যা পরীক্ষা- নিরীক্ষাপূর্বক সংশোধন করে পুনরায় পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি মহাপরিচালককে ৯ জানুয়ারি পত্র পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সচিব সংশোধিত কার্যবিবরণী নিজ দায়িত্বে হাতে হাতে মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন ১২ ডিসেম্বর। এরপর প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পন্নের মাধ্যমে তা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদনপূর্বক ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে পাঠানো হয়। সুতরাং এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কালক্ষেপণের অভিযোগ সত্য নয় বলে বিবেচিত হয়।