ভারতের সিরাম ইনস্টিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তিন কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন কিনতে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই হয় গত নভেম্বরে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত চুক্তির মাত্র ৭০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর ভারত সরকার উপহার হিসেবে দিয়েছে ৩২ লাখ ডোজ। কিন্তু গত তিন মাসে ভ্যাকসিনের কোনো চালান-ই পাঠায়নি সিরাম।
এদিকে সিরাম সময় মতো ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে না পারায় প্রথম ডোজ নেওয়া প্রায় ১৫ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাই অন্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন পেতে জোড় কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারিভাবে আসন্ন জুনের মধ্যে চীন এবং রাশিয়া থেকে ভ্যাকসিন পেতে কাজ করছে কূটনীতিকরা। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা থেকেও ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন রোববার (১৬ মে) বলেন, ‘জুনের মধ্যে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। ভ্যাকসিন এখন একটি কূটনৈতিক সরঞ্জাম (ডিপ্লোমেটিক টুলস), সুশাসন (গুড গভর্নন্সে), মানবাধিকার। পশ্চিমা বিশ্ব এগুলো অবস্থা বুঝে ব্যবহার করে। যাদের তারা দেখতে পারে না, তাদের ধাক্কা দিয়ে বলে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আর যাদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে একটা কথাও বলে না। এগুলোর সবই শোষণের হাতিয়ার। এখন ভ্যাকসিনও আরেকটা কূটনৈতিক সরঞ্জামে পরিণত হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকার কাছে প্রচুর ভ্যাকসিন আছে। তারা আমাদের মুলা দেখাচ্ছে। তারা বলছে যে, তাদের কাছে ৬০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন আছে। তারা আমাদের দিতে পারবে, কিন্তু দেয় না। আমরা প্রথম যখন তাদের কাছে ভ্যাকসিনের জন্য অ্যাপ্রোচ করি তখন শুনি যে, বাংলাদেশ তাদের তালিকায় নেই। তারা বলে, তোমাদের দেশে তো কোভিডের কোনো সমস্যা নেই। আমাদের তালিকায় ভারত, ব্রাজিল, স্পেন, ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স- এরা আছে। কেননা এদের বেশি লোক মারা যাচ্ছে এবং তারা অনেক বিপদে আছে। তারা আরও বলল, যে দেশে বেশি লোক মারা গেছে, আমরা তাদের আগে ভ্যাকসিন দেবো।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমেরিকাকে বললাম, আমরা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছি; কিন্তু সিরাম সময় মতো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারছে না। সেজন্য প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে পারছি না। আমরা এখন ঠেকায় পড়েছি। তোমাদের কাছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন আছে। তোমরা আমাদের জরুরি ভিত্তিতে অনন্ত দুই মিলিয়ন ভ্যাকসিন দাও, যাতে আমরা দ্বিতীয় ডোজটা দিতে পারি। এই প্রস্তাবেও তারা গড়িমসি করছে। এখন তারা একটা ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে, বিভিন্ন ইস্যুতে দর কষাকষি করবে। কিন্তু আমরা আমাদের স্বার্থের বাইরে যাব না।’
অন্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাকসিনের উৎস হচ্ছে চীন, রাশিয়া, আমেরিকা আর ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড অনেক খারাপ। তারা কোনো কাজেই নেই। বরং সব জায়গাতেই গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয়। তারা আমাদের অনেক ভুগিয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিনের জন্য ইংল্যান্ডের কাছে আমরা সবার আগে আবেদন করেছি। ভারতের আগেই আমরা আবেদন করি। কিন্তু আমাদের তারা বসিয়ে রাখল। ইংল্যান্ড বলল যে, ভারতের কারখানা অনেক বড়, তাদের দেবো; তারা তোমাদের দেবে। তারা আরও বলেছিল, ভারত যেদিন ভ্যাকসিন পাবে, তোমরাও সেদিন পাবে। সেজন্য শুরুতেই ভারত আমাদের ভ্যাকসিন দিয়েছিল, যা ছিল প্রাথমিক সমাঝোতা।’
ড. মোমেন বলেন, ‘এখন আমরা ইংল্যান্ডের কাছে ভ্যাকসিন চাচ্ছি। তারা বলছে, আমাদের কাছে এখন কিছুই নেই। ভারত মহাকষ্টে আছে, তাদের দিয়ে দিয়েছি। ইংল্যান্ড আরও বলছে, তোমাদের যদি দরকার হয়, তোমরা কিনে নিতে পার। আমরা কিনে নিতে রাজি হয়েছি। কিন্তু তাদের ভ্যাকসিনের দাম অনেক বেশি, গড়ে ৪০ ডলার করে। তাই এটা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ব্যবসায়ী আনলে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা করব। এটা নিয়ে কাজ চলছে। এটা দুই দেশের ব্যবসায়ী পর্যায়ের চ্যানেলে আনা হতে পারে।’
ইউরোপ থেকে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইউরোপের সাতটি দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন বেশি আছে, যা তারা ব্যবহার করছে না। এটা আমরা ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, ক্রোয়েশিয়ার কাছে মাত্র ১০ হাজার ভ্যাকসিন আছে, অস্ট্রিয়ার কাছে ২০ হাজার আছে আর ডেনমার্কের কাছে ২ লাখ। কিন্তু আমাদের এত কম ভ্যাকসিনে কাজ হবে না। আমাদের একদিনেই প্রয়োজন কয়েক লাখ। তাই এসব দেশ থেকে ১০ হাজার বা ২০ হাজার করে ভ্যাকসিন এনে আমাদের চাহিদা পূরণ করার প্রস্তাব খুব বেশি কার্যকর হবে না।’
তাহলে এখন ভ্যাকসিন পাওয়ার উৎস কী হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমরা এখন চীন আর রাশিয়া থেকেই ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করছি। তবে ওদের কাছ থেকে আগে কিনতে হবে। না কিনলে দেবে না। সেইসঙ্গে তাদের ফর্মুলা নিয়ে নিজেদের এখানে উৎপাদন করতে চাই। আশা করছি, আমরা জুনের মধ্যে ভ্যাকসিন পাব।’
জাপান থেকে ভ্যাকসিন আনার কোনো চেষ্টা চলছে কি না? জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জাপান নিজেরাই করোনা সংক্রমণের সমস্যার মধ্যে আছে। এই ইস্যুতে ওদের অবস্থা খুব খারাপ। তাই জাপানের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা চেয়েছি। কেননা ওদের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্খ খুব ভালো। জাপান মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসাও করছে। তারা বলেছে যে, তাদের সহযোগিতা করার সুযোগ আছে।’