এখন সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ঙ্কর এক নাম ‘টিকটক’। রঙ-বেরঙের চুল আর উদ্ভট পোশাক পরে মোবাইল, ট্র্যাইপড হাতে নিয়ে বিভিন্ন কায়দা কসরত করে অভিনয়ের চেষ্টা করা যুবক-যুবতীদের দেখা মিলে আশপাশে। এরাই হলো টিকটক পার্টি। নিছক শখ থেকে অ্যাপসটি ব্যবহার করতে করতে এখন সেটি ব্যবহার হচ্ছে গুরুতর অপরাধে। এখন মানবপাচারের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই টিকটক। অভিভাবক বা সুশীল মহল থেকে এই টিকটক বন্ধ করার বহু দাবি জানালেও এ ব্যাপারে কার্যত কোনো ভূমিকা নেই সংশ্লিষ্টদের।
সম্প্রতি ভারতের কেরালায় একটি হোটেলে নারী নির্যাতন করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এবং সেই কথিত টিকটক সেলিব্রিটি হৃদয় বাবুর গ্রেফতারের পর টিকটক এখন নিজেই ভাইরাল। শনিবার এই টিকটক হৃদয়ের দুই সহযোগী র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বের হয়ে আসতে শুরু হয়েছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিশেষ করে ভারতে গিয়ে নারী পাচারের শিকার হওয়া নির্যাতিতা সেই নারী বাংলাদেশে ফিরে পুলিশ প্রশাসনকে নানা তথ্য জানালে বের হয়ে আসে চক্রের ভয়ংকর সব ঘটনা।
ভুক্তভোগী ওই নারী জানিয়েছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে গ্রেফতার টিকটক হৃদয় ফতুল্লায় অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ডপার্কে টিকটক ‘হ্যাংআউট পুলপার্টি’র আয়োজন করে। তার আমন্ত্রণে ওই পার্টিতে যান তিনি। তখন হৃদয় অফার দেয়, বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ আছে। সেটা না করলে টিকটক তারকা হওয়ার পথ খোলা আছে। এরপর একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে আরেকটি পুলপার্টির আয়োজন করে হৃদয়। সেখানে ৭০০-৮০০ তরুণ-তরুণী অংশ নেয়। পার্টিতে সবাইকে মদ সরবরাহ করা হয়েছিল।
এ তথ্য ধরে নারায়ণগঞ্জে পুলপার্টির অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে পুলপার্টি আয়োজনের রহস্য। টিকটক ছাড়াও ডিজে ও পুলপার্টি ঢাকা নামে আরও একাধিক গ্রুপ রয়েছে যারা আয়োজন করে এই ধরনের ইভেন্ট। অনলাইনে তরুণ-তরুণীদের দেওয়া হয় লোভনীয় সব অফার। উন্মুক্ত রাখা হয় অসামাজিকতার সব রকম সুযোগ। ফাঁদে পা দিয়ে বহু তরুণ-তরুণী যুক্ত হয় এই পার্টিতে। আর এখান থেকে প্রথমে পরিচিত হওয়া এবং ধীরে ধীরে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে শেষে দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়।
যেভাবে আয়োজন হয় পুলপার্টির
পুলপার্টিতে মূলত দুটি উপায়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। টিকটক সেলিব্রিটিরা তাদের নিজ নিজ অ্যাকাউন্টে পুলপার্টিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। সেখানে তাদের নিজেদের অংশগ্রহণের কথাও তারা নিশ্চিত করেন। সম্প্রতি ভারতে গ্রেফতার হওয়া হৃদয় বাবু এভাবেই তার ভক্তদের পুলপার্টিতে আমন্ত্রণ জানাতেন। আরেকটি হলো ফেসবুকে বিভিন্ন প্রাইভেট গ্রুপ এবং পেজ থেকে পুলপার্টির ইভেন্ট ডাকা হয়। সেখানে টিকেট এবং নির্ধারিত ফি পরিশোধের মাধ্যমে পার্টিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা একে অপরের ঘনিষ্ট সংস্পর্শ পেতে ছুটে আসে পুলপার্টিতে।
নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্জার ল্যান্ডের সুইমিংপুল সেকশনে ৭০-৮০ জনের পুলপার্টি আয়োজন করার কথা নিশ্চিত করেছে ভুক্তভোগী এক তরুণী। ফেসবুকে খোঁজ নিয়েও এর সত্যতা মেলে। নারায়ণগঞ্জে আর কোথায় কোথায় এমন পুলপার্টি হয় এমন খোঁজ নিতে গিয়ে বেশ কিছু টিকেটের দেখা পাওয়া যায়। সেখানে ভেন্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয় সোনারগাঁয়ের নাম। তবে সোনারগাঁয়ে শুধু রয়েল রিসোর্টে সুইমিংপুল রয়েছে এবং সেখানে এই ধরনের পুলপার্টি আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয় না বলে জানা গেছে।
তবে একটি সূত্র জানায়, বন্দরের মদনপুর এলাকায় অবস্থিত সাইরা গার্ডেন রিসোর্টে সুইমিংপুল রয়েছে এবং সেখানে প্রায়ই বিভিন্ন গ্রুপ পুলপার্টির আয়োজন করে। টিকটক ব্যবহারকারীদের একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, সোনারগাঁ ভেন্যু হিসেবে মদনপুরের সাইরা গার্ডেনের নামই উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগেও সাইরা গার্ডেনের রিসোর্ট ও কটেজগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর একাধিক অভিযোগ উঠেছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইরা গার্ডেনের পুল, মাঠ এবং খাবারসহ একদিনের রিজার্ভ খরচ প্রায় ২ লাখ টাকা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাইরা গার্ডেনের ডেস্ক এক্সিকিউটিভ কামরুস সায়েদীন।
অপরদিকে অ্যাডভেঞ্জার ল্যান্ড পার্কের পুল জোনের রিজার্ভ ভাড়াও প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। তবে অ্যাডভেঞ্জার ল্যান্ড বর্তমানে বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পার্কের ইনচার্জ বাবুল।
এদিকে করোনার লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চালু রাখা রয়েছে সাইরা গার্ডেন। তারা করোনার ভেতরেও জনসমাগমের অনুমতি দিচ্ছেন দর্শনার্থীদের।
অসামাজিকতার সুযোগে ভরপুর পুলপার্টি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘ডিজে পার্টি’স ইন ঢাকা’ নামে একটি পেজে দেখা যায় আব্রাহাম হোসেইন নামে এক ব্যক্তি পুলপার্টি কল করেছেন এবং তিনি অনলাইনে টিকেট কেনার অফার দিচ্ছেন। সেখানে সিঙ্গেল টিকেট ৯৯৯ এবং কাপল ১৭৯৯ টাকায় বিক্রি করছেন। সুযোগ হিসেবে সামনে টোপ দিয়েছেন একাধিক অসামাজিকতার সুযোগ। এক্টিভিটিজের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেফটি রুম, স্মোকিং জোন, বেস্ট সিকিউরিটি, স্পেশাল পার্টি উইথ হট ডিজে অ্যান্ড গার্লস।
টিকটক ব্যবহারকারী তরুণদের মতে, সেফটি রুম মূলত অবিবাহিত কাপলদের একান্ত সুযোগ করে দেওয়ার একটি মাধ্যম। আর সুইমিংপুলের পানিতে জলকেলির নামে মেয়েদের সঙ্গে বেহায়াপনার অফুরন্ত সুযোগ করে দেয় পুলপার্টি। কোনো কোনো পার্টিতে বাড়তি টাকায় মেলে মদ ও বিয়ার পানের সুযোগ। মেয়েদের কেউ কেউ বুঝে আবার কেউ না বুঝে চলে আসে পার্টিতে। এদের অধিকাংশই বিভিন্ন গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। অল্প টাকায় চোখের সামনে এত জাঁকজমক দেখে অনেকেই নিজেকে সামলাতে পারে না।
এসব পুলপার্টির পেছনে সক্রিয় থাকে নারী পাচারকারীদের একটি চক্র। তারা বেছে বেছে কয়েকটি নারীকে টার্গেট করে। তার সঙ্গে সখ্যতা জমিয়ে বিশ্বস্ততা অর্জন করে নেয়। এরপর বিভিন্ন অফার এবং ডিস্কাউন্টের প্রলোভন দেখিয়ে আরও বেশ কয়েকটি পার্টিতে ডাকে। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করে দেয়। এরপর তাদের জায়গা হয় ভারতের কোনো হোটেল কিংবা দেহ ব্যবসায়ী চক্রের কাছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানিয়েছেন, আমরা এর আগেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় টিকটক গ্রুপের পার্টির কথা শুনেছি। নারায়ণগঞ্জে আর যাতে কোনো পার্টি এই টিকটক গ্রুপ করতে না পারে সেজন্য আমরা কাজ করছি এবং আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এই ধরনের অপকর্ম বন্ধে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।