‘টিকটক-লাইকির ভিডিও তৈরির মাধ্যমে আয়ের সুযোগ’— এমন প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-তরুণীদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। পরে বিভিন্ন দেশে পার্লার, সুপার শপ, কিংবা বড় শপিং মলে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তার সূত্র ধরে নারীপাচারের একটি বড় চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রটির নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের টার্গেট স্কুল-কলেজপড়ুয়া মেয়েসহ বিবাহিত গৃহিনী ও বখে যাওয়া ছেলে-মেয়ে। টিকটকের মডেল বানানোর টোপ দিয়ে তরুণীদের ভারতে পাচারের ফাঁদে ফেলেছে চক্রটি। বিভিন্ন সময় ভারতে নিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকজনকে।
ঘটনার তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, এই নারীপাচার চক্রটির নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, ভারতের কিছু এলাকাসহ দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে নেটওয়ার্কটি বিস্তৃত।
তেজগাঁও বিভাগ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভারতে নির্যাতিত ওই তরুণীকে পাচারে প্রধান অভিযুক্ত রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। যিনি টিকটক হৃদয় হিসেবেই পরিচিত। টিকটক হৃদয় মানবপাচার চক্রের একজন সাপ্লায়ার। যিনি আলোচিত ওই তরুণীসহ আরও বেশ কয়েকজনকে পাচার করছেন— এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তসাপেক্ষে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নারীপাচার চক্রের গ্রুপের পার্টি
টিকটকের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের একটি গ্রুপ পরিচালনার তথ্য পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। যে গ্রুপের অ্যাডমিন ও পৃষ্ঠপোষক ওই আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রটি।
একটি গ্রুপের অ্যাডমিনের তত্ত্বাবধানে গত বছরের শেষের দিকে ঢাকার পাশের একটি জেলায় পুলপার্টির আয়োজন করা হয়। ওই পার্টিতে প্রায় ৭০০-৮০০ তরুণ-তরুণী অংশ নেন। এ গ্রুপ থেকেই নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন মার্কেট, সুপার শপ, বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভনে পাচার করা হয়।
অনেককে পাচার করেছে চক্রটি
ভারতের ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে এ চক্রের মাধ্যমে আরও অনেক তরুণীকে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। সঠিক সংখ্যা এখনও নিশ্চিত না হলেও এটি নেহাত কম নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এমন আরও গ্রুপ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করতে নির্যাতন
ভারতে এ চক্রটির মূল আস্তানা ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। মূলত দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করতেই বিভিন্ন বয়সীদের ভারতে পাচার করা হয়। তাদের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় কিছু হোটেলে চুক্তি থাকে। সে অনুযায়ী তারা টাকার বিনিময়ে তরুণীদের সরবরাহ করে।
পাচার হওয়া তরুণীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করতে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে বিবস্ত্র করে ছবি তোলা ও ভিডিও করা হয়। শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। তাদের কথা মতো অনৈতিক কাজ করতে রাজি না হলে ছবি-ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। তাদের হাতে রাখতে এবং বাধ্যতামূলকভাবে অনৈতিক কাজ করাতে এটা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কৌশল।
মানবপাচারে জড়িতরা ভারতে গেছে অবৈধ পন্থায়
নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের পর ভারতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচিত হয়। পরে ভারতীয় পুলিশ দ্রুততম সময়ে তাদের গ্রেফতার করে। ভুক্তভোগী তরুণীকে উদ্ধারসহ মূল অভিযুক্ত টিকটক হৃদয় এবং আরও চারজনকে গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া গেছে। যারা প্রত্যেকেই অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের কাছে ভিসা কিংবা পাসপোর্ট কিছুই ছিল না।
জড়িতদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে
শনিবার (২৯ মে) ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা হয়েছে। জড়িতদের ভারত থেকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হচ্ছে। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে ভারতেও মামলা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু তারা বাংলাদেশি এবং এখানে মামলা হয়েছে তাই তাদের ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, তদন্তে আরও বেশকিছু পাচারের তথ্য পাওয়া গোছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে চাচ্ছি না। ভিকটিমের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
ভারতে বাংলাদেশি ওই তরুণীকে যৌন নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২৭ মে) হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী মেয়ের বাবা। প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ থাকা মেয়েকে ভিডিও দেখে শনাক্তেন পর মামলা দায়ের করেন তিনি।
এর আগে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ জানায়, সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের এক তরুণীর যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ভারতের কেরেলা রাজ্যে সংঘটিত ওই ঘটনায় ঢাকার হাতিরঝিলের রিফাদুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক যুবকে শনাক্ত করে পুলিশ।
ওই সময় ডিসি মো. শহিদুল্লাহ জানান, গত কয়েকদিন ধরে ভারতে ধারণ করা তরুণীকে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওটির সূত্র ধরে তদন্তের একপর্যায়ে জানা যায়, নির্যাতনকারী ওই যুবকের নাম রিফাদুল ইসলাম হৃদয়। নিজ এলাকা হাতিরঝিলে টিকটক হৃদয় নামে পরিচিত রিফাতুল ইসলাম হৃদয়কে তার পরিবারের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়।