টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় এ খাতে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বিটিআরসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হতে পারে। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে বিটিআরসি। এ খাতে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও এক ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, আইন সংশোধন হলে তাদের বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। টেলিযোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে কর্তৃত্ব বদলের জন্য আইন সংশোধন টেলিযোগাযোগ খাতে সুফল বয়ে আনবে না, বরং নতুন সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে।
অবশ্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘আইন ও নীতিমালার মধ্য দিয়ে টেলিযোগাযোগ খাত সঠিক পথেই এগোচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার পথে কিছু সমস্যা হতেই পারে, এগুলো বড় করে দেখার কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইন সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রায় দুই দশক আগে প্রণীত টেলিযোগাযোগ আইন এক দশক আগে সংশোধন হয়েছিল। এখন আবার প্রয়োজন বিবেচনাতেই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি সম্পন্ন হতে আরও অনেক প্রক্রিয়া বাকি। ফলে এ নিয়ে এখনই কারও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’
আইন সংশোধনের প্রস্তাব : ২০০১ সালে প্রণীত টেলিযোগাযোগ আইনে বিটিআরসিকে একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সে অনুযায়ী বিটিআরসি সরকারের অধীন হলেও একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১০ সালে এ আইনটি সংশোধন করে বিটিআরসির সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা খর্ব করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এবার আইন সংশোধনের জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে সেখানে আইন থেকে ‘স্বাধীন কমিশন’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘কমিশন’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় বিদ্যমান আইনে ‘একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘সরকারের একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ শব্দ দুটি বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে ‘সরকারের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। বিদ্যমান আইনের ২১ ধারায় টেলিযোগাযোগ খাত থেকে আয় বিটিআরসির নিজস্ব তহবিলে জমা রাখার বিধান আছে। সেটি সংশোধন করে সরকারি কোষাগারে জমা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনের ১২ ধারায় সংশোধন এনে বলা হচ্ছে, কোনো কমিশনার পদে বহাল থাকার অযোগ্য বিবেচিত হলে তার সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারবে। ২০০১ সালের আইনে এবং ২০১০ সালের সংশোধিত আইনে কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের এক বা একাধিক বিচারক সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান ছিল। বিশ্নেষকরা বলছেন, নতুন সংশোধন প্রস্তাবে বিটিআরসির কমিশনের অপসারণের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে সরাসরি ন্যস্ত করা হচ্ছে। এতে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হবে।
এ ছাড়া আইনের ১৮ ধারায় সংশোধন এনে লোক নিয়োগ থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কমিশনের বিভিন্ন পদে প্রেষণে নিয়োগের সুযোগও বিস্তৃত করা হয়েছে।
নতুন আইনের খসড়ায় আইনটির প্রয়োগ অংশে নতুন একটি উপধারা সংযুক্ত করে তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে থেকে এ দেশের কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতি বা বেতার ব্যবস্থার সাহায্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইন এমনভাবে প্রয়োগ করা যাবে যে, অপরাধটি বাংলাদেশের ভেতরেই সংঘটিত হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন নিয়ে খোদ বিটিআরসির ভেতরেই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেভাবে আইন সংশোধনের কথা বলা হয়েছে তা চূড়ান্ত হলে আক্ষরিক অর্থে বিটিআরসির চরিত্র আর ‘কমিশন’ থাকবে না। এমনকি অধিদপ্তরও নয়, এটা মন্ত্রণালয়ের একটা অনুবিভাগে পরিণত হবে। এ কারণে বিটিআরসির কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রণীত টেলিযোগাযোগ পলিসিতে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০২ সালে বিটিআরসি একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে তার কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের যে আত্মবিশ্বাস, তার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে বিটিআরসি। বিটিআরসির সুশৃঙ্খল ও দূরদর্শী নীতিমালা, গাইডলাইন, অপারেশন এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের ফলেই আজকে এই খাত অনেক উন্নতি করেছে। বিগত ১৮ বছরে বিটিআরসির সফল নিয়ন্ত্রণের ফলে সরকারি কোষাগারে ৬০ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব জমা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, টেলিযোগাযোগ হচ্ছে একটি কারিগরি বিষয়। এটা পরিচালনায় ও রেগুলেটরি কার্যক্রমে দক্ষ ও কারিগরি কর্মকর্তা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোতে কমিশনের লোকজন এ ব্যাপারে ব্যাপক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। এ কারণে দক্ষ লোকদের হাতেই কারিগরি বিষয়গুলো থাকাই যুক্তিযুক্ত। কমিশন হওয়া দরকার একটি ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার। সব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে গেলে কিংবা অনুমোদনের জন্য একাধিক ধাপ পার হতে হলে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা হতে পারে। গ্রাহকের মূল্যবান সময় নষ্ট হতে পারে। এ কারণে আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে ২০২০ এবং পরবর্তী সময়ের কথা বিবেচনা করে প্রজন্মের চাহিদার সমন্বয়ের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বর্তমান আইনে কোনো দুর্বল দিক থাকলে তাও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিটিআরসি সরকারের অধীনে থাকলে উদ্বেগের কী আছে? এতে কোনো ক্ষতি নেই। বিটিআরসি সরকারে একটি সংস্থা। সরকার বা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তিনি বলেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনেক সিদ্ধান্তেই অর্থ, আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এতে কি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হয়? প্রেষণে বিটিআরসিতে কর্মকর্তা নিয়োগ তো নতুন নয়। সরকারি কর্মকর্তারা সেখানে প্রেষণে নিয়োগ পেলে সমস্যা কোথায়? সরকারি অর্থ তো সরকারের কোষাগারেই জমা হবে। সরকার
বিটিআরসির কোনো বিষয়ে তদন্ত করতে চাইলে আপত্তি উঠবে কেন? তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে যারা আছেন তারাই টেলিযোগাযোগ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারাও কারিগরি বিষয় এবং সার্বিকভাবে টেলিযোগাযোগ খাত সম্পর্কে খুবই স্বচ্ছ ধারণা রাখেন। অতএব, আইন সংশোধন হলে বিটিআরসি ধ্বংস হবে না, বরং আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, এ আইনের সংশোধনের উদ্যোগ একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এখনও বহু প্রক্রিয়া বাকি। এমনকি মন্ত্রণালয়েও আইনটি আসেনি। অতএব, এ আইন নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, টেলিযোগাযোগ খাত কোন দিকে যাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির রূপান্তর কীভাবে হচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রেখে নীতি ও আইনের সংশোধন হওয়া দরকার। শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিলে সেটি কোনো সুফল দেবে না। বরং টেলিযোগাযোগ খাতে আরও কিছু সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে।
একটি অন্যতম শীর্ষ টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে যে নীতিমালা নেওয়া হয়, দেখা যায় কিছুদিন পর সেগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না। উল্টো এমন সিদ্ধান্ত চাপানো হয়, যেগুলো কার্যত নীতিমালার বিরুদ্ধে যায়। এ অবস্থায় আইনের সংশোধন এবং বিটিআরসির কার্যক্রমে বড় পরিবর্তন এলে সেটা দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়।