নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বসন্ত বরণে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিভাগটির চেয়ারম্যান ফজলুল হক পলাশ ও প্রভাষক দোয়েল আক্তারের বিরুদ্ধে৷ এ তালিকায় নাম এসেছে বিভাগের ৯ম ও ১৫ তম ব্যাচের আরও চার শিক্ষার্থীরও৷ তারাই বিশেষ যোগ্যতায় বারবার এ বিভাগের সকল অনুষ্ঠানের দেখ-ভালের দায়িত্ব পান৷ এদিকে এ ঘটনার তদন্ত চেয়েও বিশ্ববিদ্যালের প্রক্টর বরাবর অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা৷
ব্যয় বিবরণী বিশ্লেষণ: হার মানছে বালিশ কান্ড-
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ওই অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ফজলুল হক পলাশ ও দোয়েল আক্তারের সরবরাহ করা ব্যয় বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি বিভাগের শুধু ফটোসেশনেই বিল করা হয়েছে ৮ হাজার ৪০০ টাকা৷ বাজারের সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ন সাউন্ড সিস্টেম এনেও তার বিল করা হয়েছে ১১ হাজার ৩০০ টাকা৷ এ বক্স (সাউন্ড সিস্টেম) এনে আবার মেরামত বাবদও বিল হয়েছে আরও ৪০০ টাকা৷ ছোটখাটো এই ঘরোয়া আয়োজনের ত্রিপল ভাড়া ৭৬০ টাকা, মঞ্চ সাজানোর বাঁশ ভাড়া ১ হাজার পাঁচশ টাকা, মিস্ত্রি ১৩০০ টাকা, ব্যানার বাবদ বিল করা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা, গার্ড ও খালাকে ১৬৫০ টাকা, দেয়ালিয়া ১৫০০ টাকা, হাড়ি ১৪৫০ টাকা, রিক্সা ভাড়া ৮০০ টাকা, দড়ি ২০০ টাকাসহ প্রতিটি খাতে আলাদা বাজেট রাখার পরেও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে হাওয়া হয়ে গেছে ২৭ হাজার ৩৫০ টাকা৷ অতিথি কেউ না থাকলেও ভৌতিক অতিথিদের জন্য করা হয়েছে আপ্যায়ন বিলও৷ এদিকে মশার কয়েলেও বিলও ধরা হয়েছে ২০০ টাকা৷ বাদ যায়নি মামার দোকানের বিলও৷ এ যেন রুপপূরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দের বালিশ কান্ডকেও হার মানিয়েছে৷
গ্রুপ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোড়পাড়-
বসন্ত বরণের নামে ফজলুল পলাশের এই ভুতুড়ে বিল-ভাউচার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের গ্রুপেও রীতিমতো ঝড় উঠেছে৷ পলাশের এই ভুতুড়ে বিলের ছবিসহ নিন্দা জানিয়ে “ডিআইইউতে যেসব পাপ দেখেছি” নামের একটি গ্রুপে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন ” এই লিস্ট টা বসন্ত বরন উৎসব ২০২৪ এর খরচের লিস্ট। আচ্ছা আমার প্রশ্ন হলো ৮২ হাজার প্লাস টাকা উঠছে; ৮২ হাজার টাকা দিয়ে একটি ছোট খাটো বিয়ের আয়োজন করা যায়।
ওই শিক্ষার্থী আরও লিখেছেন, সাউন্ড সিস্টেম ও লাইটিং এ ১১ হাজার খরচ হইছে। সাউন্ড কোয়ালিটি বলতে গেলে খুবই জঘন্য ছিল। তারপর ফটোগ্রাফি ৮ হাজার ভাইরে ভাই৷ সব জায়গা থেকে ইচ্ছা মতো টাকা মেরেছে। টং ওয়ালা মামারেও বাদ দিল না৷ প্রোগ্রাম হইছে ১৭ তারিখ তারা ২ দিন আগে ১৫ তারিখে ৯০০ টাকার কি খাইছে? সব কিছু ভুয়া তালিকা।
এদিকে এই ভুতুড়ে বিলের নিন্দা জানিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের গ্রুপে আরেক শিক্ষার্থী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না) বলেন, ২৭ হাজার ৩৫০ টাকার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বলতে তাহলে আমরা বুঝি লাল নীল কিছু কাপড় আর বাতি। যেহেতু বাঁশ ভাড়া, সাউন্ড সিস্টেম, ব্যানার সহ সকল কিছুর আলাদা বাজেট করা হয়েছে । তাহলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খরচ কি? লাল নীল কিছু কাপড় আর বাতিতে ২৭ হাজার ৩৫০ টাকা?
একই গ্রুপে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ৩৫০ টাকা সামান্য টাকা না। ২৫ কেজি ধানের টাকা। অনেক বাবার একদিনের শ্রমের টাকা। এমন হলে পরবর্তী কোন প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার আগে ভেবে দেখব।
এস কে শাকিল নামের এক শিক্ষার্থী একটি গ্রুপ ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ভাই ব্রাদার প্লাস ৮৪ হাজার টাকার ছবি৷ এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নেতিবাচক মতামত ও প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের অনেকেই৷
এ বিলের ক্ষোভ জানিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, বিভাগের প্রতিটি প্রোগ্রামে জোর করে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়৷ অংশগ্রহণ করলে নাকি পরীক্ষায় মার্কস যোগ হবে৷ আমরা অনেকে বাধ্য হয়েই অংশগ্রহণ করতে হয়৷ শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রুরেও যেতে বাধ্য করা হয়৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এখানে যা মন চায় তাই হয়৷ ইউনিভার্সিটির এসব বিষয় দেখে আমি অবাক৷ আমার অন্য ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের এমন অভিজ্ঞতা নেই৷
অনুষ্ঠানে খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, কাচ্চির প্যাকেটে ডিম খিচুড়ি দিয়ে মনটা না ভাঙ্গলেও পারতো! এর আগে এ বিভাগ থেকে পলাশ ও দোয়েলের নেতৃত্বে সাতারকুলের বেরাইদে একটি নৌকা ভ্রমনের আয়োজন করা হয়৷ সে ভ্রমনেও একবেলা নৌকা ভ্রমনের বিল করা ২০ হাজার টাকা৷ এ ঘটনা নিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী কথা বললেও তাদের ওপর নেমে আসে বেহাল দশা৷
সমাবর্তনের ছবি তুলতেও হয় না এমন বিল-
পলাশের এই ভৌতিক বিলের নিন্দা জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনের ছবি তুলতেও এত বিল হয়না৷ সেখানে তো মন্ত্রীও থাকেন৷ আমরা দুই থেকে তিনজন ফটোগ্রাফারকে জনপ্রতি ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে দেই৷ তবে ক্ষেত্র বিশেষ এটা সর্বোচ্চ ৪ হাজার হয়৷ কিন্তু এত ছোট অনুষ্ঠানে এত টাকার ছবি তোলার বিল কেন সেটা বুঝলাম না৷ ফজলুল পলাশ সাহেব ট্রাস্টিবোর্ড চেয়ারম্যানের (শামীম হায়দার পাটোয়ারী) কাছের লোক হওয়ায় সবকিছুতেই রামরাজত্ব তার৷
নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগও পলাশের দিকে-
শুধু ভুতুড়ে বিল ভাউচারই নয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সায়েরা (ছদ্মনাম) সাথেও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পলাশ৷ মেসেঞ্জার এবং হোয়াটস অ্যাপ এ ও নিয়মিত করেছে যৌন হয়রানি৷ পাঠিয়েছে আপত্তিকর ছবি ও মেসেজ৷ ভুক্তভোগী ওই নারী শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমাকে পলাশ যেভাবে যৌন হয়রানি করার চেষ্টা করেছে সেটা বলার ভাষা নেই৷ আমি লোক লজ্জার ভয়ে কিছুই বলতে পারিনি৷ সে শুধু আমাকে নয় বিভাগের আরও কয়েক শিক্ষার্থীর সাথেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে৷ সে একজন চরিত্রহীন শিক্ষক৷ টুরের নামে তার অপকর্ম অনেকেই জানেন৷ ” এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক আবু তারেক অবধি গড়ালেও তিনি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন৷ এসব ঘটনার সকল প্রমানই এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে৷
বিশেষ ক্ষমতায় একাই দুই বিভাগের চেয়ারম্যান পলাশ!
আশ্চর্য হলেও ফজলুল পলাশ একাই দীর্ঘদিন দুই বিভাগের চেয়ারম্যান৷ অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে বিশেষ তিনি একাই দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ সমাজবিজ্ঞান বিভাগেও রয়েছে তার প্রভাব৷ অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে একাধিক যোগ্য শিক্ষক থাকার পরেও পলাশই যেন সর্বেসর্বা৷
মুখ খুললেই পরীক্ষার খাতায় দেখে নেবার হুমকি-
অনুসন্ধান বলছে, ফজলুল পলাশ ও প্রভাষক দোয়েল মিলে বিভাগের আরও আজ্ঞাবহ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের দিয়ে কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে হরিলুটের আয়োজন করে৷ এদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ মুখ খুললেই চলে আপমান, বহিস্কার আর পরীক্ষায় দেখে নেবার হুমকি৷
কি বললেন পলাশ-দোয়েল?
এ প্রসঙ্গে বিভাগের চেয়ারম্যান ফজলুল হক পলাশ বলেন, বিলটা নিয়ে আপত্তি করছে শিক্ষার্থীরা৷ আমরা এটা নিয়ে আলাদা আলাদা কমিটি করে দিয়েছিলাম৷ দোয়েল আক্তারকে আহ্বায়ক করা হয়েছিল সেই কমিটিতে৷ কয়েকজন শিক্ষার্থীও ছিলো৷ দুপুরে আমাদের আলোচনা হবে এসব বিষয় নিয়ে৷ এটা আমাদের বিভাগীয় বিষয়৷ কোন শিক্ষার্থীরা এই কমিটিতে ছিলো জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান৷
এদিকে প্রভাষক দোয়েল আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাকে বিব্রত করবেন না৷ আমি কিছুই বলতে পারবোনা৷ আপনি চেয়ারম্যান স্যার এর সাথে কথা বলুন৷
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন,”অভিযোগের বিষয়টি আমি দেখবো৷ “