ঢাকা ওয়াসায় ঠিকাদারি কাজ পেতে ঘুষ লেনদেন একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয়ও গুরুত্ব পায়। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া, স্পেসিফিকেশন ও ডিজাইন অনুযায়ী কাজ না করা এবং প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। এসব কাজের সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জড়িত থাকেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দেওয়া ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক এসব তথ্য উপস্থাপন করে। ১১টি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা রোধে ১২টি সুপারিশও করা হয়।
পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনে অনিয়ম
বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনে দাতা সংস্থার গাইডলাইন ও ঋণচুক্তির শর্ত মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্তারোপ করা হয়ে থাকে, যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক ঠিকাদারই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে স্পেসিফিকেশন ও ডিজাইন অনুযায়ী প্রকল্প কাজ যথাসময়ে শেষ হয় না এবং প্রকল্পের ব্যয়ভার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়।
বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার অতিরিক্ত পানি সরবরাহে ২০১৫-এর মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জুন মেয়াদে ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
প্রকল্পটিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ সময়ে ৫১ শতাংশ কাজ হলেও আরও কিছু নির্মাণ ও পুনর্বাসন কাজ অন্তর্ভুক্ত করে পুনরায় ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। ইতোমধ্যে যে কাজ হয়েছে এর সঙ্গে ঠিকাদারকে পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য রয়েছে।
ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প ২০১৬-এর এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হলেও ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এটির তেমন অগ্রগতি নেই। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও তা হয়নি।
৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকার ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০১৯ মেয়াদে শেষ হওয়ার কথা। ইতোমধ্যে ২৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০১৯ মেয়াদে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা। প্রায় ১০১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও কাজের অগ্রগতি একেবারেই নগণ্য। আগারগাঁও এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পটি জুন ২০১৭ মেয়াদে সম্পন্ন করার কথা। এটিরও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ে দুর্নীতি
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসা এখনো ম্যানুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এ সুযোগে প্রকৌশল ও রাজস্ব শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। ওয়াসার বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীকে যে ওভারটাইম বিল দেওয়া হয়, তা তাদের মূল বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী ওভারটাইম না করেও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এ বাবদ বিল তোলেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের ওভারটাইম বিল অনেক বেশি।
দুদকের ১২ সুপারিশ
সুপারিশগুলো হচ্ছে- ওয়াসার চলমান প্রকল্পের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ অপচয় রোধে বিভিন্ন প্রকৌশল সংস্থার অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে যৌথ পরিমাপ টিম ও মনিটরিং টিম গঠন। প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরির সময় কাজের যথার্থতা ও উপযোগিতা আছে কিনা তা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত হওয়া এবং বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যেন অহেতুক না বাড়ানো হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি আরোপ। দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটিতে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিসহ টেন্ডার ও ক্রয়কার্য যথাযথ হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিংয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক শক্তিশালী টিম করা। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের সময় ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার প্রকল্প পরিদর্শনসহ প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। বিল পরিশোধের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদার যতটুকু কাজ করছে তার গুণগত মান যাচাই করে বিল পরিশোধ করা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিটার রিডিং চালু। অবৈধ ওভারটাইম বিল রোধে জনবল কাঠামো সুনির্দিষ্ট এবং বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম বিলের সমন্বয় সাধনসহ বিধিমালা প্রণয়ন। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা ওয়াসার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন, সওজ, বিদ্যুৎ বিভাগ ইত্যাদি) সমন্বয়। ঢাকা ওয়াসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে গণমাধ্যম, দুদক, অডিট ডিপার্টমেন্টসহ নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া গণশুনানির আয়োজন; মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকালে সার্ভিল্যান্স টিমের আকস্মিক পরিদর্শন; বিভিন্ন ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত ও ই-টেন্ডারিং, দরপত্র আহ্বান, কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব প্রদান এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বুয়েটসহ অন্যান্য পেশাদার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।