ধর্ম ডেস্ক,
ইসলামে দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের বিধিসম্মত নিয়মের নাম বিয়ে। একটি বয়সে উপনীত হলে নারী-পুরুষ উভয়েরই একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। যার সঙ্গে শেয়ার করা যায় যাপিত সময়ের সুখ-দুঃখ। বিয়ের মাধ্যমে পুরুষ নারীর প্রতি দায়বদ্ধ হয়, নারী দায়বদ্ধ হয় পুরুষের নিকট। এক্ষেত্রে দায়িত্ব সম্মান শ্রদ্ধা স্নেহ ভালোবাসা ও অধিকার—সবকিছুর সমন্বয় করে চলতে হয়। এক পক্ষীয় দায়বদ্ধতা নয়, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যজ্ঞান দাম্পত্য সম্পর্কে স্বর্গীয় সুখ এনে দেয়।
ইসলামে যদিও বিবাহবন্ধন আজীবনের জন্য সম্পাদন করা হয়, কিন্তু এমন বাস্তবতায় বিবাহবন্ধন বিচ্ছিন্ন করারও সুযোগ রাখা হয়েছে। ইসলাম কখনোই বিবাহবন্ধন ছিন্ন করাকে উৎসাহিত করে না। বরং স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মিল মহব্বত সৃষ্টি করা ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্য নানা পন্থা ও উপায় বলে দিয়েছে। কারণ, বিবাহবন্ধন বিচ্ছিন্ন করার ফলে শুধু স্বামী-স্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, তাদের সঙ্গে দুটি পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং সন্তানের জীবনও ধ্বংস হয়। তাই অসহযোগিতার অবস্থায় প্রথমে একে অপরকে বুঝানো তারপর ভয়ভীতি প্রদর্শনের উপদেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি এতে তারা বাধ্য হয়ে যায় তাহলে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান কর না।’ (সুরা নিসা : ৩৪)
তালাকের পরিচয়:
তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধনমুক্ত করা। শরীয়তের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা। তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষের অর্থাৎ স্বামীর। আর স্ত্রীর অধিকার খুলা করার। খুলার আভিধানিক অর্থ খসিয়ে নেয়া, টেনে বের করে ফেলা। আর শরীয়তের পরিভাষায় স্বামীকে কিছু মাল দিয়ে নিজকে স্বামীর বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করে নেয়া। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তবে তাদের উপর কোনো গুনাহ হবে না যদি স্ত্রী স্বামীকে মাল দিয়ে নিজকে ছাড়িয়ে নেয়’। (সুরা বাকারা : ২২৯) তাছাড়া স্বামীর অর্পিত ক্ষমতাবলেও স্ত্রীর তালাক দেয়ার ক্ষমতা আছে।
তালাক বা খুলার প্রয়োজনীয়তা:
পারিবারিক জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে একজন নর ও একজন নারী। এই দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয় বা একে অপরের জীবন সাথী হিসেবে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা হয় বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে। উভয়ের সুখ-শান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক মত বিনিময় ও দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপের মধ্যে উভয়ের আচার-আচরণ ও পারস্পরিক চাহিদার ভিত্তিতে দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে। সাংসারিক জীবনের উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের উপর নির্ভরশীল স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি। কিন্তু যদি উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের অবহেলা দেখা দেয় যখন একে অপরের মতের সঙ্গে একমত না হয় ও একে অপরের আচরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে না পারে। যার কারণে উভয়ের দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তির পরিবর্তে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। পারছে না তারা সুখের নীড় রচনা করতে। এমতাবস্থায় বা অন্য কোনো কারণে যদি কেউ বিবাহ বিচ্ছেদ কামনা করে, তাহলে ইসলাম সে ব্যবস্থা করেছে তালাক বা খুলার মাধ্যমে। যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়, তা হলে যুক্তিসঙ্গত নিয়মে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্যে তালাক বা খুলার বিধান রাখা হয়েছে। তালাক দেবার অধিকারী হচ্ছে একমাত্র স্বামী। আর খুলা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্ত্রী নিজেকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক স্বামী তালাক দিলে সে তালাক কার্যকরী হবে। কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা পাগল স্বামী তালাক দিলে তা কার্যকরী হবে না।
ইসলামে তালাকের স্থান:
যদিও ইসলামে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্যে তালাকের বিধান রয়েছে, তবুও ইসলাম তালাককে জায়েজ কাজসমূহের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই যথাসম্ভব উক্ত জায়েজ ঘৃণিত কাজ থেকে বেঁচে থাকা উচিত এবং সমাজে তালাক যাতে বেশি পরিমাণে না হয় তার চেষ্টা করা উচিত। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘হালাল বিষয়সমূহের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত বিষয় হচ্ছে তালাক।’ (আবু দাউদ)। বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রতিরোধকল্পে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি হাদিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আলী (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, ‘বিবাহ করো কিন্তু তালাক দিও না। কেননা তালাকের কারণে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে।’ ‘হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, বিশেষ অসুবিধা ব্যতীত যে স্ত্রী তার স্বামীর নিকট তালাক চায় তার জন্য বেহেশতের সুঘ্রাণও হারাম হয়ে যায়’ (তিরমিযি)। ‘কোনো মুমিন (স্বামী) কোনো মুমিনাকে (স্ত্রী) যেনো অপছন্দ না করে। সে তার কোনো বৈশিষ্ট্যকে অপছন্দ করলেও তার অন্য বৈশিষ্ট্য সন্তুষ্ট হবে।’ (সহীহ মুসলিম) তালাক প্রদানের বিধান শরীয়াত কর্তৃক অনুমোদিত হলেও চূড়ান্ত প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে মনোমালিন্য ও বিরোধ দূর করার কয়েকটি পথ বলে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
‘তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহর কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অন্বেষণ করো না’ (সূরা নিসা : ৩৪) ‘তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশঙ্কা করলে তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রী) পরিবার হতে একজন সালিশ নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিস্পত্তি চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত’ (সুরা নিসা : ৩৫)।
তালাকের প্রকারসমূহ:
তালাক একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর নর-নারীর দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও শান্তিময় করে তোলার জন্য এবং একটি পারিবারিক জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়োজনে তালাকের পথ গ্রহণ করা যায়। তালাককে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে : (ক) তালাকে আহসান, (খ) তালাকে হাসান বা ভালো তালাক এবং তালাকে বিদআত।
এক তালাক প্রধান করে মুদ্দত অতিক্রান্ত করাকে আহসান তালাক বলে। তিন তুহূরের মধ্যে তিন তালাক প্রধান করাকে তালাকে বিদআত বলে। তিন তালাকে সীমাবদ্ধ থাকলে স্ত্রীকে পুনরায় বিনা আকদে গ্রহণ করা যায়। তবে ‘বায়েন’ বললে নতুন আকদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বায়েন তালাক:
যদি এক বা দুই তালাক বায়েন ছাড়া বলে, তাহলে ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ না করেই গ্রহণ করা যায়। আর যদি বায়েনসহ তালাক বলে, তাহলে পুনরায় বিবাহ করে স্ত্রীকে গ্রহণ করতে হয়। বায়েনসহ তালাক দিলে পুনরায় বিবাহ করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করার সুযোগ থাকায় এই তালাককে মুখাফ্ফাফ বায়েন বা হালকা বায়েন বলে।
মুগাল্লাযা বায়েন তালাক:
একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াকে মুগাল্লাযা বায়েন তালাক বলে। একসঙ্গে তিন তালাকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে নিয়ে আর পুনরায় ঘর করা যাবে না। আর সেই তালাক সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণ হয়ে গেল। পুনরায় বিবাহ করে ঘর-সংসার করার আর কোনো সুযোগ থাকলো না। তবে যদি ভবিষ্যতে উক্ত নারীর অন্যের সঙ্গে বিবাহের পর পুনরায় সে যদি তালাকপ্রাপ্ত হয় বা তার স্বামী মারা যায়, তাহলে সে প্রথম স্বামীর সঙ্গে ইচ্ছা করলে বিবাহ বসতে পারবে বা উক্ত পুরুষ তাকে ইচ্ছা থাকলে বিবাহ করে ঘর করতে পারবে।
রিজয়ী তালাক:
‘রিজয়ী’ শব্দের অর্থ প্রত্যাবর্তনযোগ্য। এটা এমনি ধরনের তালাক যা প্রয়োগ করলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা যায়। বায়েন ছাড়া এক বা দু’তালাককে রিজয়ী তালাক বলে। ইদ্দতের মধ্যে উভয়ে একমত হলে পুনরায় স্বামী-স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে ঘর-সংসার করতে পারবে, পুনরায় আর কোন বিবাহের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু ইদ্দত পুরা হয়ে গেলে এই তালাক বায়েক তালাকে পরিণ হয়ে যায়। তখন স্ত্রীকে গ্রহণ করতে চাইলে বিবাহের প্রয়োজন হবে। বিনা বিবাহে গ্রহণ করা যাবে না। আর পুনরায় না আনার ইচ্ছা করলে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।
যদি এক তালাক দিয়ে স্ত্রীকে ইদ্দতের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনে তারপর আবার তাকে আরেক তালাক দিল, এং ফিরিয়ে আনলো। তারপরও আবার আরেক তালাক দিল। এবার তাকে আর বিনা বিবাহে তো দূরের কথা, বিবাহ করেও আনা জায়েজ হবে না।
তালাকের শব্দ:
তালাকে দু’ধরনের শব্দ ব্যবহার করা যায়। প্রথমত, অর্থবোধক প্রকাশ্য শব্দ যাতে প্রকাশ্যে তালাক বোঝা যায়। যথা : কেউ বলল, আমি আমার স্ত্রীকে তালাক দিলাম। দ্বিতীয়ত, এমনি শব্দ যার একাধিক অর্থ হতে পারে। উক্ত শব্দ দ্বারা তালাক নির্ভর করে তালাকদাতার নিয়্যতের উপর। যথা : কেউ বলল, ‘আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও বা তুমি আমার বাড়ি থেকে চলে যাও’ ইত্যাদি আরো অনেক প্রকার শব্দ হতে পারে। এ সব শব্দ দ্বারা তালাক নির্ভর করে তালাকদাতার নিয়্যতের উপর।
আর প্রকাশ্য শব্দ দ্বারা তালাক দিলে এবং উক্ত শব্দগুলো যতবার বলবে, ততবার তালাক হবে। যথা : কেউ যদি তার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে, ‘তোমাকে তালাক দিলাম’, ‘তোমাকে তালাক দিলাম’, তারপর যদি বলে তোমাকে ‘তোমাকে তালাক দিলাম’। তাহলে সর্বমোট তিনবার তালাক বলায় তিন তালাক হয়ে যাবে। প্রকাশ্য শব্দগুলো যদি হাসতে হাসতে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলে এবং মনে নিয়্যত না থাকে তবুও তালাক হয়ে যাবে।
বিএসডি/এএ