আন্তর্জাতিক ডেস্ক
এক এক করে গোটা আফগানিস্তানের দখল নিজেদের হাতে নিয়ে গেছে তালেবান। রাস্তা-ঘাট, বাজার-দোকান থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ- সর্বত্র এখন বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন বাহিনীটির যোদ্ধারা। যদিও পেছন থেকে অনেকাংশেই কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের মতো কিছু দেশের বিরুদ্ধে।
কূটনৈতিক শিবিরের দাবি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে পাক সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সরাসরি মদতপ্রাপ্ত পাক-তালিবান গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ইসলামাবাদের এই সম্ভাব্য বাড়বাড়ন্তে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লি।
সূত্রের খবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে শীর্ষ সদস্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছেন, সেখানে আটকে থাকা ভারতীয়দের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বৈঠকে মোদী বলেন, ভারত কেবল নিজের দেশের নাগরিকদের রক্ষা করবে না। আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু শিখ ও হিন্দুদের অবশ্যই আমাদের আশ্রয় দিতে হবে। যে আফগান ভাই-বোনেরা সাহায্যের জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দিতে হবে।
এরই মধ্যে তালেবানের সশস্ত্র অভিযানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন পশ্চিমা সমর্থিত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। তার মতো ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহও দেশ ছেড়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হলেও সে তথ্য মোটেও সত্য নয়। এখনো আফগানিস্তানেই অবস্থান করছেন তিনি।
শুধু তা-ই নয়, আশরাফ ঘানির অবর্তমানে নিজেকে আফগানিস্তানের বৈধ তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্ট বলেও ঘোষণা দিয়েছেন আমরুল্লাহ সালেহ। খবর আল-জাজিরার।
মঙ্গলবার টুইট বার্তায় আমরুল্লাহ সালেহ বলেছিলেন, আফগানিস্তানের সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের অবর্তমানে, পালিয়ে গেলে, পদত্যাগ করলে বা মৃত্যু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্টের পদ সামলান। আমি এখনো দেশের ভেতরেই রয়েছি এবং আমিই সেই বৈধ তত্ত্বাবধায়ক প্রেসিডেন্ট। আমি বিশ্বনেতাদের কাছে সহযোগিতা ও সমর্থন চাই।
এ দিকে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর পুরো পরিস্থিতির দায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপাল এশিয়ার পরাশক্তি চীন। বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, আফগানিস্তানকে ‘লণ্ডভণ্ড’ করে দেশে ফিরে গেছে মার্কিন সেনারা।
ন্যাটো ও আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ফলে তালিবান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিষ্কার রাস্তা পেয়েছে। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, আফগান সৈন্যদের এতদিন ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অস্ত্রভাণ্ডারে সুসজ্জিত করার পরও তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা গড়ে তোলা যায়নি। সারাজীবন আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনা থাকতে পারে না। এ বার থেকে লড়াই আফগান সেনাকেই লড়তে হবে।
এই কথার সূত্র ধরেই আমেরিকাকে এক হাত নিয়েছে চীন। মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেছেন, আমেরিকা আফগানিস্তানকে লণ্ডভণ্ড অবস্থায় ফেলে চলে গিয়েছে। এখন সে দেশে চারিদিকে অশান্তি, বিভেদ ও ভঙ্গ পরিবারের দেখা মিলছে। আমেরিকার ভূমিকায় এমন। সবসময় ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় আমেরিকা, গড়তে পারে না।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের সঙ্গে আফগানিস্তানের মোট ৭৬ কিলোমিটার জুড়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সেই কারণেই বেইজিংয়ের চিন্তা, দেশের উইঘুর মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঠাই হতে পারে ওই সীমান্ত বরাবর ভূমিতে। যদিও গত জুলাই মাসে চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে সে ব্যপারে আশ্বাস দিয়েছে তালেবান। সংগঠনটি জানিয়েছে, চীনে সন্ত্রাসবাদ চালানোর জন্য কোনো গোষ্ঠী আফগান ভূমি ব্যবহার করতে পারবে না।
এ দিকে আফগান ভূমি ব্যবহার করে কেউ প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তালেবান। রাজধানী কাবুল দখলের পর মঙ্গলবার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর প্রতি এমন বার্তাই দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইসলামিক আমিরশাহি বিশ্বের সমস্ত দেশকে জানাতে চায়- আফগানিস্তান কাউকে হুমকি দেবে না।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে নিয়ে আমরা সরকার গড়তে চাই। আমরা দেশের ভিতরে বা বাইরে কোনো শত্রু চাই না। আমাদের কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই। আমাদের নেতার নির্দেশে আমরা সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
এ দিকে আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধাদের আগ্রাসনের আশঙ্কায় ২০ হাজার আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। মঙ্গলবার ব্রিটেন সরকার বিবৃতির মাধ্যমে ঘোষণাটি দেয় বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আফগান নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্কে দেশ ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। মূলত নিরাপত্তা ও জীবনের নিশ্চয়তার আশায় দেশ ছাড়ছেন তারা। এর আগে কানাডা ও উগান্ডা ২০ হাজার করে আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদানের কথা জানিয়েছিল।
বিবিসি নিউজ জানিয়েছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মোট ২০ হাজার আফগান শরণার্থীকে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে। আর তখন থেকেই তারা যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি পাবেন। প্রথম বছর এই সুযোগ পাবেন মোট পাঁচ হাজার আফগান শরণার্থী। যদিও এক্ষেত্রে নারী, কিশোরীসহ ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এ দিকে আফগান শরণার্থীদের উদ্ধারে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল। মঙ্গলবার ব্রিটিশ মিডিয়া দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে এক লেখায় তিনি বলেছেন, আফগান শরণার্থীদের বিষয়ে আমরা একা কিছুই করতে পারব না।
অর্থনৈতিক চাপে তালেবান
যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৯ বিলিয়ন ডলার সম্পত্তি জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারকে এই অর্থ ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতেই পদক্ষেপটি নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
বুধবার মার্কিন প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বরাতে এই অর্থ জব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
ওয়াশিংটনের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত ব্যাংক একাউন্টগুলোতে থাকা যে কোনো আফগান রিজার্ভ তালেবানকে গ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে না।
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘দা আফগান ব্যাংক’ (ড্যাব) ভারপ্রাপ্ত প্রধান আজমল আহমদি সোমবার (১৬ আগস্ট) একটি টুইট করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, বর্তমানে ড্যাবের ৯.৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদ রয়েছে। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত শুক্রবার আমি জানতে পেরেছি যে- যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য তালেবানের কোনো পদক্ষেপ দেখলেই সেই ডলারের চালান বন্ধ হয়ে যাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, তালেবান বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের অর্থ হলো তারা আর কোনো তহবিল ব্যবহার করতে পারবে না। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির মতে, ড্যাবের সম্পদের বড় একটি অংশ বর্তমানে আফগানিস্তানে নেই।
উল্লেখ্য, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
আফগান নারীদের জন্য শরিয়াহ আইন
আফগানিস্তানের নারীরা এবার তালেবান শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন। এছাড়া ঘরের বাইরে যেতে হিজাব পরলেই চলবে। এমনকি বোরকা পরা বাধ্যতামূলক নয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন। তিনি কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান দফতরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সুহাইল শাহিন বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু আছে। সেখানে মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। নারী শিক্ষার বিষয়ে তালেবানের ইতিবাচক নীতির কথা এর আগে মস্কো ও দোহা সম্মেলনেও বলেছি।
বোরকা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, নারীরা মাথায় হিজাব পরেছেন কি না সেটা পর্যবেক্ষণ করা হবে। তবে পুরো শরীর ঢাকা বোরকা পরতেই হবে এমন নয়।
তিনি আরও বলেন, অনেক ধরনের হিজাব রয়েছে। বোরকা আর হিজাব একই জিনিস নয়।
আফগানিস্তানে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে তালেবান শাসনামলে নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের পড়াশোনার অনুমতি ছিল না। নারীদের চাকরি করা নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের ভ্রমণের অনুমতিও ছিল না। ফলে এবার তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর নারী শিক্ষা, বোরকা ও নারী অধিকার প্রসঙ্গে ভাবনার উদ্রেক হয়।
যদিও মঙ্গলবার ‘এই তালেবান ২০ বছর আগের তালেবান নয়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন সংগঠনটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।
আফগানিস্তান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গনি সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বিশ বছর আগেও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। আজও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু অভিজ্ঞতা, পরিপক্বতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বিশ বছর আগের তালেবানের সাথে আজকের তালেবানের বিশাল তফাত রয়েছে। আমরা এখন যেসব পদক্ষেপ নেব তার সাথে ওই সময়কার তফাত রয়েছে। আর এটা বিবর্তনের ফসল।
তিনি বলেছিলেন, অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পন্থা, নিয়ম-কানুন আছে। অন্যদের মতো আমাদেরও (আফগানদের) মূল্যবোধ অনুযায়ী নিজস্ব নিয়ম-কানুন থাকার অধিকার রয়েছে। আমরা শরিয়াহ আইনের অধীনে নারীদের অধিকারের প্রতি সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।
নারী অধিকার প্রসঙ্গে তালেবানের নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন, নারীরা আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে যাচ্ছে। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে চাই যে, নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না।
এ দিকে তালেবান তাদের সরকারে নারীদের যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছে। বাহিনীটির সাংস্কৃতিক কমিশনের সদস্য ইনামুল্লাহ সামানগানি এ আহ্বান জানান।
সামানগানি বলেন, শরিয়াহ আইন অনুযায়ী সরকারে নারীদের উপস্থিতি থাকা উচিত। এখনো সরকারের কাঠামো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে পুরোপুরি ইসলামিক নেতৃত্ব থাকবে। এতে সব পক্ষেরই যোগ দেওয়া উচিত।
মঙ্গলবার প্রথমবার সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকার কী হবে, সে বিষয়ে এসময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। জাবিউল্লাহ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে তিনি বারবারই বলার চেষ্টা করেছেন ইসলামিক আইনের আওতায় থেকে নারীরা কাজ করতে পারবেন।
বিএসডি/এমএম