নিজস্ব প্রতিবেদক:
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণে করোনার ধাক্কা লেগেছে। গত দুই বছর করোনার কারণে ঋণ পরিশোধ না করলেও তা খেলাপি করা হয়নি। এ বছর থেকে ওই সুবিধা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি করা হচ্ছে। এ কারণে জানুয়ারি থেকে মার্চ-এ তিন মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা অনুযায়ী ঋণের কিস্তি ছয় মাস বকেয়া থাকলে খেলাপি করার নিয়ম রয়েছে। যে কারণে চলতি জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির খেলাপি ঋণ প্রভিশনিং বিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনটি অনুমোদন করেছেন। প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদনটি হালনাগাদ করে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণের এ চিত্র বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। এটি চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯ সালে আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে-বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চে নিঃসন্দেহে সে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। যা ৪ লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাল ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে-এ তথ্য ভুয়া।
কারণ আদালতের নির্দেশে বিপুল অঙ্কের ঋণ আটকে আছে। যেগুলো খেলাপি করা যাচ্ছে না। ২ শতাংশ সুবিধার আওতায় অনেক মন্দ ঋণ খেলাপির ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে রিশিডিউলের আওতায় আছে আরও বড় অঙ্কের ঋণ। ঋণ অবলোপনসহ সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের তথ্য এখনও কার্পেটের নিচেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপিকে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। তা না হলে এ টাকা আদায় হবে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে যা ছিল ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এ তিন মাসে ঋণ স্থিতি বেড়েছে ২৭ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্চ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। ওই তিন মাসে বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ খেলাপি ছিল।
গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে মূল কারণ দেশে খেলাপিদের ঋণ শোধ না করার বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। সুদ কমানো হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব সুবিধা পেয়ে তারা আর ঋণ শোধ করে না। তারা মনে করে খেলাপি হলেই বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর যারা সুবিধা নিয়ে ঋণ নিয়মিত করে রেখেছে, তাদের হিসাব যোগ করলে খেলাপির অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে পরিচালন ব্যয় অতিমাত্রায় বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, টাকা নিলাম ফেরত দিলাম না, কোনো শাস্তিও হলো না। তাহলে ফেরত দেবে কেন? কোনো গ্রাহক যদি জানে সে খেলাপি হলে তিরস্কার নয় পুরস্কার পাবে তাহলে তো সে খেলাপি হবেই। তাই একটাই সমাধান শাস্তি। যত দ্রুত সম্ভব খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে যতই নির্দেশনা দেওয়া হোক কাজ হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ২০ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এ সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলো ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এ সময়ে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোভিডের পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকট আসায় একটা টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে রপ্তানি কমে যাচ্ছে, রেমিট্যান্সও কম আসছে, আমদানি বাড়ছে। আমদানি ব্যয় পরিশোধে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সবাই। কিন্তু ঋণ আদায় করার ব্যাপারে অনেকটা শিথিলতা ভাব, এতে ব্যাংকের মূল স্তম্ভই তো দুর্বল হচ্ছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে বারবার ডলারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। খেলাপি নিয়ে ব্যাংকারদের খেয়াল নেই। এখন ঋণ আদায় ঢিলে হয়ে গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।
করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় ছাড় দেওয়া হয়। ওই সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা থাকায় গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ না করতে পারলেও তা খেলাপি করা হয়নি। ফলে নতুন করে খেলাপি ঋণের হার খুব একটা বাড়েনি। জানুয়ারিতে ওই সুবিধা তুলে দেওয়া হয়েছে। ১৯ জানুয়ারির মধ্যেও মোট ঋণের বা কিস্তির ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়েছে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে যেসব ঋণের কিস্তি পরিশোধের কথা সেগুলো পরিশোধিত না হলে তা খেলাপি করার নির্দেশনা দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। এর আলোকে ব্যাংকগুলো কিস্তি পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন দিয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) একটি প্রতিনিধি দল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে গ্রাহকদেরকে খেলাপি না করার সময়সীমা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছেন।
বিএসডি/ এমআর