আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
তারা বেশ চালাক-চতুর। শেখালে চটপট শিখে নিতে পারে। মানবশিশুর থেকেও বেশি তাড়াতাড়ি। হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে দরজা খুলে বাথরুমে যায় গরুরা। ক্ষেতখামারে যেখানে সেখানে মূত্র ও মলত্যাগ করে না। কাজ হয়ে গেলে বাথরুম অপরিষ্কার হয় সেটা ভালই বোঝে। তাই মূত্র ও মলত্যাগের পর বাথরুম পরিষ্কার করার জন্য ‘ফ্লাশ’ টেনে দেয়ে তারা। তার পর দরজা খুলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
গল্প-কথা নয়। কল্প-কাহিনীও নয়। একটি সাম্প্রতিক গবেষণা এই নজরকাড়া খবর দিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা কারেন্ট বায়োলজিতে। গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে জার্মানির রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ফার্ম অ্যানিমাল বায়োলজি (এফবিএন) ও নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
গবাদি পশু ও গ্রিনহাউস গ্যাস
চাষবাসের এলাকা বাড়ায় ক্ষেতখামারে গবাদি পশুর ত্যাগ করা বর্জ্য পদার্থ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। পরোক্ষভাবে তৈরি হচ্ছে অত্যন্ত বিষাক্ত অ্যামোনিয়ার মতো গ্রিনহাউস গ্যাস। এর ফলে বাড়ছে উষ্ণায়নের বিপদ। যা দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত আগস্টে জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ক্ষেতখামারে গবাদি পশুর বর্জ্য পদার্থ থেকে কীভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো যায় তার উপায় খুঁজতে বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দেওয়া হয়।
অ্যামোনিয়া গ্যাস যে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ, বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু গবাদি পশুর মাটিতে মেশা মল, মূত্র থেকে তৈরি হওয়া অ্যামোনিয়াকে ব্যাক্টেরিয়াসহ কয়েকটি অণুজীব বদলে দেয় নাইট্রাস অক্সাইডে। যা কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের পর তৃতীয় বিপজ্জনক গ্রিনহাউস গ্যাস। চাষবাস থেকেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অ্যামোনিয়া গ্যাসের নির্গমন হয়। যার অর্ধেকের জন্যই দায়ী গবাদি পশুদের মল ও মূত্র।
মানুষের তিনটি ধারণায় আঘাত
গবেষকরা তাদের গবেষণায় আমজনতার তিনটি বহুলপ্রচলিত ধারণার মূলে কার্যত আঘাত করেছেন। প্রথমত, তারা দেখিয়েছেন— মূত্র ও মলত্যাগ করার জন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেয় গবাদি পশু। ব্যাপারটা এমন নয় যে অপেক্ষা করতে না পেরে তারা হঠাৎই মল, মূত্র ত্যাগ করে ফেলে সদ্যোজাত মানবশিশুর মতো।
দ্বিতীয়ত, গবেষকরা দেখিয়েছেন— বাথরুমে গিয়ে মল, মূত্রত্যাগ করার অভ্যাসে রপ্ত করাতে চাইলে তারা সেটা খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। সদ্যোজাত মানবশিশু, এমনকি, ২-১ বছরের শিশুদের চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি এই অভ্যাসে রপ্ত করানো যায় ক্ষেতখামারের গবাদি পশুকে।
তৃতীয়ত, গবেষকরা দেখিয়েছেন— খাবারদাবারের উপহার পেলে মানবশিশুর চেয়ে গবাদি পশুরা বেশি তাড়াতাড়ি এই অভ্যাসে রপ্ত হয়ে ওঠে। যা প্রমাণ করেছে মানবশিশুর চেয়ে গবাদি পশুরা বেশি চালাক-চতুর।
এই গবেষণার অন্যতম গবেষক পশু মনোবিদ জান ল্যাংবিন বলেছেন, ‘ক্ষেতখামারে গরু, মহিষের মতো গবাদি পশুদের যেখানে সেখানে মল ও মূত্রত্যাগের জন্য চাষের জমি ও তার ভেতরের নালা, আলগুলো দূষিত হয়। আবার সেই গবাদি পশু যদি ক্ষেতখামারে শস্য রাখার আস্তানায় মল ও মূত্রত্যাগ করে, তাতে সেগুরো দীর্ঘদিন সেখানে থাকতে থাকতে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি করে। যা একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। তাই আমরা চেয়েছিলাম গবাদি পশুর বাথরুম ব্যবহারের অভ্যাসে রপ্ত করিয়ে অ্যামোনিয়ার মতো বিষাক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বাতাসে কমিয়ে আনতে।’
গবাদি পশুকে কীভাবে শেখানো হল এই অভ্যাস?
এ ব্যাপারে গবাদি পশুদের প্রশিক্ষণ দিতে একটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন গবেষকরা। যে পদ্ধতির নাম ‘মুলু ট্রেনিং’। এই অভ্যাসে রপ্ত হয়ে ওঠার জন্য ক্ষেতখামারের গবাদি পশুদের প্রথমে লোভনীয় খাবারদাবারের টোপ দেওয়া হয়েছিল। তার পর শেখানো হয়েছিল মল ও মূত্র ত্যাগের প্রাক মুহূর্তে কীভাবে দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকতে হবে। আর কীভাবে কাজ শেষ হয়ে গেলে বাথরুম পরিষ্কার করে দিতে হবে।
ল্যাংবিন জানিয়েছেন, বাথরুম ব্যবহারের অভ্যাসে রপ্ত করানোর জন্য প্রাথমিকভাবে গবাদি পশুদের জন্য কিছুটা কড়া শাস্তিরও ব্যবস্থা রেখেছিলেন গবেষকরা। বাথরুমের বাইরে মল, মূত্র ত্যাগ করলেই গবাদি পশুদের দেওয়া হত কড়া শাস্তি। দীর্ঘক্ষণ খাবার বা পানি না দিয়ে। অল্পবিস্তর চড়-থাপ্পর মেরেও। গবাদি পশুদের কানে গুঁজে দেওয়া হতো ইয়ার ফোন। এর মাধ্যমে তাদের শোনানো হতো খুব কর্কশ শব্দ। গায়ে পানিও ঢেলে দেওয়া হতো।
সদ্যোজাত মানবশিশুর চেয়েও তাড়াতাড়ি শেখা!
গবেষকরা জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণেই ভালো সাড়া মেলে। ১৬টি গবাদি পশুর মধ্যে ১১টিই বাথরুমে গিয়ে মল, মূত্র ত্যাগ করা ও বাথরুম পরিষ্কার করার অভ্যাসে রপ্ত হয়ে ওঠে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে। যেটা সদ্যোজাত মানবশিশুকে শিখতে অনেক বেশি সময় লাগে। এমনকি, ২-৩ বছরের শিশুদেরও।
গরুরও আত্মসম্মান বোধ রয়েছে!
গবেষকরা বিস্ময়ে দেখেছেন আরও একটি ঘটনা। গবাদি পশুরও আত্মসম্মান বোধ আছে। একজন তাড়াতাড়ি বাথরুমে যাওয়ার অভ্যাসে রপ্ত হয়ে উঠছে দেখলে অন্যজন সেটা পারেনি বলে অস্বস্তি বোধ করে। চেষ্টা করে কত তাড়াতাড়ি সেও এই অভ্যাসে রপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
আনন্দবাজার।