নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী নির্বাচন করতে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন তা করে আগামী দেড়-দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন চায় আমার বাংলাদেশ পার্টি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনী সময় দেয় সেই সময় রক্ষা করতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দিহান মজিবুর রহমান মঞ্জু।
সংলাপ শেষে শনিবার (৫ অক্টোবর) সাড়ে ৮টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এ কথা বলেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রতি আস্থা পাচ্ছে না জনগণ। এখনো পুলিশ ভালোভাবে কাজ করছে না। মনোবল অনেক দুর্বল। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার পরও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি।
বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কাজ হতাশাজনক দাবি করে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে বলেছি। প্রয়োজনে এসব মন্ত্রণালয়ে নতুন উপদেষ্টা নিয়োগের কথা বলেছি।
বাজার নিয়ন্ত্রণ ও যানজটে মানুষ অসুন্তষ্ট ও বিরক্ত দাবি করে তিনি বলেন, মানুষ অস্থির হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বিরক্ত।
দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে তা করে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেন সরকার দেয়। ওনারা আমাদের কথায় আশ্বস্ত করেছেন আমাদের কথা খুবই যুক্তিযুক্ত।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করেন ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলের আহ্বায়ক এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, যুগ্ম আহবায়ক আব্দুল ওহাব মিনার, সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, সহকারী সদস্য সচিব নাসরিন সুলতানা মিলি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার দুই দফা সংলাপ হয়, এটি তৃতীয় দফা সংলাপ।
এর আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপ হয়।
৬ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা প্রস্তাবনা
এবি পার্টির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৬ দফা পর্যবেক্ষণ ও ১১ দফা দাবি, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দলের সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।
প্রস্তাবনা ও পর্যবেক্ষণগুলো হলো-
১। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ২ মাস পূর্ণ হতে চলেছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার জাতির উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছেন। এতে তিনি সরকারের লক্ষ্য, অভিপ্রায়, অঙ্গীকার ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রমের বিবরণ, অগ্রগতি, প্রতিবন্ধকতা এবং বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন ও রূপকল্প তুলে ধরেছেন।
২। গত ২ মাস যাবত নানা প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়সহ বেশকিছু ক্ষেত্রে সরকারের কাজে গতিশীলতা এবং সাফল্য পরিলক্ষিত হলেও বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের কাজ বেশ মন্থর ও দুর্বল বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মাণ হয়েছে। বিশেষ করে জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের কাজে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব এবং সমন্বয়হীনতার কারণে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার-ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার বিষয়টি বেশ হতাশাজনক। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনও ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার সহযোগী-প্রতিভূরা বসে আছে। পুলিশবাহিনী অকার্যকর, দুর্বল ও নৈতিক মনোবলহারা। সশস্ত্রবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি।
৩। ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর দুঃশাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার যে রক্তস্নাত গণঐক্য তৈরি হয়েছিল বর্তমানে সে ঐক্যে কিছুটা ক্ষত ও মৃদু ফাটল পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশব্যাপী পাবলিক ইউনিভার্সিটি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসাছাত্রদের মধ্যে পুর্বেকার প্রেরণা ও দৃঢ় বন্ধন নেই। রাজনৈতিক দলগুলোও নানা কারণে বাকযুদ্ধে লিপ্ত। সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয় না থাকার বিষয়টিও এক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এসব কিছুর প্রভাব নাগরিকদের মন ও মননে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৪। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা নিয়ে স্পষ্ট রূপকল্প এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ৬টি কমিশন করার কারণে জনমনে যে আগ্রহ ও উৎসাহ তৈরি হয়েছিল কমিশনের কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হওয়ায় তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
৫। শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, আহতদের সুচিকিৎসা এবং গণহত্যার নির্দেশ ও মদদদাতাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে সুসংবদ্ধ পদক্ষেপের অভাব লক্ষণীয়।
৬। সরকারের বৈধতা এবং প্রকৃতি নিয়ে ধোঁয়াশা ক্রমশ জটিল হচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে সরকার আইন ও সংবিধান মানার কথা বলছে আবার কিছুক্ষেত্রে আইন-সংবিধান মান্য করার চাইতেও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এতে সরকারের দ্বিমুখিতা প্রকাশ পাচ্ছে ও সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
দাবি, পরামর্শ ও প্রস্তাবনা
১। আগামী ২ মাসের মধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো, পুলিশকে পূর্ণভাবে সক্রিয় করার চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাত্মক সহায়তা নিয়ে দেশের সর্বস্তরে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা সুদৃঢ় করা।
২। জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, আইন ও স্বাস্থ্যসহ যেসব মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয় সেখানে দায়িত্ব রদবদল বা নতুন উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে কার্যকর গতিশীলতা আনয়ন করা। প্রয়োজনে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সহকারী উপদেষ্টা নিয়োগ করা।
৩। সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের মাধ্যমে সরকারের বৈধতার সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সরকারের বৈধতার প্রশ্নে আপাতত একটি আইনি প্রতিরক্ষা তৈরি করা যা অর্ডিন্যান্স জারি করেও করা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধন বা প্রণয়নের জন্য একটি কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করা এবং সংবিধান রচনার পর গণভোটে সেটি পাস করানো।
৪। অবিলম্বে গণতদন্ত কমিশন গঠন করে জুলাই-আগস্টে সংগঠিত সব নৃশংসতার ঘটনা জাতির সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। প্রতিটি শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনে স্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। আহত ও পঙ্গু ছাত্র-জনতার চিকিৎসা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। সিভিল প্রশাসন ও সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তা ও সিপাহীদের মধ্যে যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের বিষয়ে একটি পৃথক কমিশন গঠন করা, যারা নিগ্রহ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাদেরকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনা বা সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৫। ফ্যাসিবাদের দোসর, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগী ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের বিচারের জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচারক নিয়োগ দিয়ে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম শুরু করা, বিলম্বের কারণে বহু আসামি পালিয়ে যাচ্ছে, বহু আলামত নষ্ট হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা একান্ত আবশ্যক, পিলখানা ও শাপলা চত্বরের গণহত্যার জন্যও পৃথক বিচার কমিশন গঠন করা।
৬। যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ ইতোমধ্যে এ প্রসঙ্গে যেসকল সুপারিশ তুলে ধরেছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা, কমিশনগুলো যাতে নির্ধারিত সময়ে তাদের কার্যক্রম শেষ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে তার জন্য সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রদান করা, ৬টি কমিশনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাত নিয়েও একটি জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করছি। সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌ বাহিনীর সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্যও পৃথক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৭। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার ঐক্যকে সুসংহত করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী সমন্বয় টিম গঠন করে দেওয়া যাদের মূল দায়িত্ব হবে অভ্যুত্থানে জড়িত সকল পক্ষের মতামত গ্রহণ ও যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে একটি কার্যকর সমন্বয় সংযোগ গড়ে তোলা। এই সমন্বয় টিম একটি জাতীয় সমঝোতা স্মারক তৈরির লক্ষ্য নিয়েও কাজ করতে পারে।
৮। দ্রব্যমূল্য সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু রাখা। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দুর্নীতি বন্ধ করা, ফুটপাত জনগণের চলাচলের জন্য হকারমুক্ত করা, অসহনীয় যানজট নিরসনসহ প্রাত্যহিক জনভোগান্তি দূর করার জন্য প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও পরিবর্তন-প্রত্যাশী ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কমিউনিটি মনিটরিং টিম গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯। ফ্যাসিবাদী সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে দেশবিরোধী যেসব চুক্তি করেছে তা পর্যালোচনা করা দরকার। দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশে ও বিদেশে তাদের সম্পদ জব্দ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
১০। রাজনৈতিক দল ও সকল সামাজিক পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শিগগির সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে যাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দেওয়া যায় সে লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো।
১১। ছাত্র-জনতার অপরিসীম ত্যাগ, রক্তদান ও জীবনের বিনিময়ে যে স্বপ্ন ও অর্জন তাকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সে অনুভূতি ও চ্যালেঞ্জ মনে রেখে কাজ করতে হবে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার জন্য নিজ নিজ সম্পদের হিসাব দেওয়ার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দুই মাস পর পর প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কাজের অগ্রগতি জাতির সম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে।