নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে। এরপর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দেশজুড়ে বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। স্টামফোর্ড ইউনির্ভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ তুলে ধরেন ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম সম্পাদক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী, উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসি উদ্দিন, প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ওাশিদা বেগম, আইনবিদ মারুফা গুলশান আরা প্রমুখ।
গবেষণা প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি দূষণ পরিলক্ষিত হয়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুরের পর দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা ও তৃতীয় অবস্থানে নারায়ণগঞ্জ রয়েছে। সেগুলোর বায়ুমান ছিল যথাক্রমে ২৫২ দশমিক ৯৩ ও ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম। সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে প্রায় চার-পাঁচ গুণ বেশি। এরপর চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কিশোরগঞ্জ।
গবেষণা প্রবন্ধে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় শিল্পকারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোকে ওই দূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বায়ুদূষণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা ও প্রাকৃতিক জলাধার রয়েছে। এছাড়া এলাকায় রাস্তা সংস্কার কাজের পরিমাণও কম। সবচেয়ে কম দূষিত শহরের মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর, যার বায়ুমান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম। মাদারীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ৬৪ জেলার বায়ুমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে ওই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যে গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সর্বমোট ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম। এটি দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় ১.৫৭ গুণ বেশি।
গবেষণার তথ্যানুযায়ী, সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ছিল মিশ্র এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১১১ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাণিজ্যিক (১১১ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম), রাস্তার সংযুক্তি (১১০ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম), আবাসিক শিল্প (১০৬ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম) এবং সংবেদনশীল এলাকা (১৭ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম)। এদিক থেকে তুলনামূলক কম দূষণ পরিলক্ষিত হয় গ্রামীণ এলাকায়, যার মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৯৪ দশমিক ০২ মাইক্রোগ্রাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভালো বায়ুমানের জেলাসমূহের (প্রতি ঘনমিটারে ০-৬৫ মাইক্রোগ্রাম) ৬৪টি জেলার মধ্যে শুধু ১০টি (১৫ দশমিক ৬২%) জেলায় বায়ুরমান ভালো পাওয়া যায় (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে) এবং সেই জেলাগুলো হলো—কুড়িগ্রাম (৬৩ দশমিক ৩৩ মাইক্রোগ্রাম), নাটোর (৬৩ দশমিক ১৯ মাইক্রোগ্রাম), জয়পুরহাট (৫৮ দশমিক ২৪ মাইক্রোগ্রাম), রাজবাড়ী (৫৮ দশমিক ২২ মাইক্রোগ্রাম), রাজশাহী (৫৬ দশমিক ৪১ মাইক্রোগ্রাম), পাবনা (৫৬ দশমিক ২২ মাইক্রোগ্রাম), সিরাজগঞ্জ (৫৫ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম), মেহেরপুর (৫৩ দশমিক ৩৭ মাইক্রোগ্রাম), পটুয়াখালী (৫১ দশমিক ৪২ মাইক্রোগ্রাম) এবং মাদারীপুর (৪৯ দশমিক ০৮ মাইক্রোগ্রাম)। এসব এলাকা ভৌগোলিকভাবে নদীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় দূষণের বিস্তৃতি কম। রাজশাহী শহরে ভালো মানের বায়ু পরিলক্ষিত হওয়ার পেছনে রাজশাহী শহর কর্তৃপক্ষের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ক্যাপস দেশব্যাপী গত বছর ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪ জেলার জেলা শহরগুলোতে ভূমি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের বস্তুকণার মান পর্যবেক্ষণ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। এই গবেষণায় ৬৪টি জেলা থেকে ৫৩১টি সংবেদনশীল এলাকা (১৬ দশমিক ৭৯%), আবাসিক এলাকা ৪৪০টি (১৩ দশমিক ৯১%), মিশ্র এলাকা ৪০৭টি (১২ দশমিক ৮৭%), বাণিজ্যিক এলাকা ৫৭৫টি (১৮ দশমিক ১৮%), রাস্তার সংযুক্তি এলাকা ৩৫৮টি (১১ দশমিক ৩২%), শিল্প এলাকার ৪৩২টি (১৩ দশমিক ৬৬%) এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ৪২০টি (১৩ দশমিক ২৮%) তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এই স্থানগুলো থেকে স্বয়ংক্রিয় এয়ার কোয়ালিটি মনিটর ব্যবহার করে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।