আমাদের অতি চেনা পৃথিবীটা চোখের সামনে বদলে গেল। জানালার বাইরে তাকালে নিজের এলাকাও অপরিচিত মনে হয়। তরুণদের আড্ডামুখর জায়গাগুলো নিশ্চুপ। তবে অবিশ্বাস্য হলেও বলতে হবে, খুব দ্রুতই আমরা নতুন অভ্যাসগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটি একটি অদ্ভুত সময়। কিছুদিন আগেও যা ছিল কল্পনার অতীত, তাই আজকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছি, বা মানতে বাধ্য হচ্ছি। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব হয়তো শেষ হবে, ফিরে আসবে অনেক কিছুই স্বাভাবিকতায়। কিন্তু এই নতুনভাবে বেঁচে থাকার উপায়গুলো অনেকের জন্যই হয়ে পড়বে স্বাভাবিক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়া হয়তো আর সমীচীন বা ফলপ্রসূ হবে না। ইংরেজিতে আমরা হরদমই বলছি ‘নিউ নরমাল’, অর্থাৎ আমাদের জীবনে নতুন অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া।
এই তো এ বছরেরই ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে কোপেনহেগেনে ছিলাম টেলিনর গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মিটিংয়ে। বিভিন্ন দেশের ৯ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং গ্রুপের অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। কথা হচ্ছিল ফেব্রুয়ারি ২৩-২৫ তারিখে স্পেনের বার্সেলোনায় অনুষ্ঠেয় মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের বিষয়ে। আমাদের সবারই সেখানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যেই প্রশ্ন আসছিল, মোবাইল কংগ্রেসে যাওয়া এবার সমীচীন হবে কি না। এর কয়েক দিন পরেই জানতে পারি, করোনা বিস্তারের জন্য মোবাইল কংগ্রেস আর হচ্ছে না। মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল ও প্রযুক্তিবিষয়ক আয়োজন, যা প্রতিবছরই হয়ে থাকে। কংগ্রেস না হলেও প্রযুক্তির উদ্ভাবন কিন্তু থেমে থাকেনি, থামবেও না।
২ মার্চ আবার গেলাম নরওয়ের রাজধানী অসলোতে। টেলিনর গ্রুপের এশিয়া মার্কেটের হয়ে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ডে’তে প্রতিনিধিত্ব করলাম। আমি আমাদের এশিয়ার প্রবৃদ্ধির বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললাম। এরপরের দুই মাসে সবকিছু বদলে গেল। তবে আমাদের কিন্তু থেমে থাকলে চলবে না। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মোবাইলের যে ভূমিকা, তা চালিয়ে নিতেই হবে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন থেমে গেলে তো সবই থেমে যাবে। নতুনকে এখন স্বাভাবিক মেনে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে অনলাইন মিটিংয়ে অনেক আলাপ-আলোচনার সাহায্যে আমাদের টেলিনর গ্রুপের একটা বড় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন হয়ে গেল, থেমে থাকেনি বড় কোনো সিদ্ধান্তই।
মার্চের ১৫ তারিখ দুপুরে কী যেন মনে হলো, আমাদের ম্যানেজমেন্ট টিমের তিনজনকে বললাম নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে। প্রথমে তাদের একটু আপত্তি ছিল, সময়ের ব্যবধান তো আছেই, প্রয়োজন নিয়েও প্রশ্ন ছিল। জোর করেই সেই দিন বিকেলেই পাঠিয়ে দিলাম। তিনজন তিনটি দেশে—নরওয়ে, জার্মানি ও মন্টেনেগ্রো। এখন চারটি দেশে বসে আমাদের কাজ চলছে—গ্রামীণফোন চলছে। আমরা দেশে বসে সকাল আটটায় কাজ শুরু করি, তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় সময় ভোর চারটা থেকে। আমরা জানি, দুর্যোগের এই সময়ে টেলিযোগাযোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টেলিযোগাযোগ সেবা সচল থাকতে হবে, সবাই সচল থাকবার জন্য।
মার্চেই একই সময়ে আমরা গ্রামীণফোন কর্মীদের হোম অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। অনেকেরই চোখ ছানাবড়া। বড় বড় কোম্পানি থেকে ফোন করে জানতে চাইল, আসলেই কি তাই? দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বড় করে খবর ছাপা হলো, গ্রামীণফোন কর্মীদের অফিস করতে বলেছে বাসা থেকে। জাতীয় খবর হয়ে গেলাম আমরা। আর আজকে তো এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে আমাদের সবার জন্য। এর মধ্যে আমরা শিখে নিলাম নতুনভাবে কাজ করার উপায়গুলো। এমনকি গণমাধ্যমের অফিসগুলোও কোয়ারেন্টিন অফিস চালু করেছে, খবর সরবরাহ থেমে থাকেনি।
নিজের ঘরে সহধর্মিণী তার পুরো সময়টা দিয়ে দিল অনলাইনে জ্ঞান অর্জনে, সারা পৃথিবীর ইতিহাস আমি জানছি এখন। অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে ফেলা যাচ্ছে খুব সহজেই। বাজারের জন্য আমাদের কাজ আর না থাকলেও অনেক বেশি ডেলিভারি ম্যানের দরকার হবে। বাচ্চারা পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে অনলাইন পড়াশোনা। একজন শিক্ষক ছিলেন বাসায় এসে পড়াতেন, কিন্তু এখনো বেসিক ফোন ব্যবহার করেন—আয়ত্ত করে নিয়েছেন অনলাইনে পড়ানো। এগুলো খুবই স্বাভাবিক, এ রকমই হওয়ার কথা। বদলে গেলেন আমার শাশুড়ি ৭৫ বছর বয়সী লীনা কবিরও। সানবিম স্কুলের শিক্ষক বাধ্য হলেন নাতি জাদীদ আজমানের কাছ থেকে জুম অ্যাপ কীভাবে কাজ করে, তা শিখে নিতে। অনলাইনে এখন ক্লাস নিতে হবে তো!
কিছুদিন আগে একটা অনলাইন কনফারেন্সে যোগ দিলাম। আয়োজক ছিলেন এটুআইয়ের আনীর চৌধুরী, যোগ দিয়েছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, এনটিএমসির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান, বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক, ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল, ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহফুজুল করিম মজুমদার এবং চারটি অপারেটরের সিইও, কর্মকর্তারাসহ অনেকে। আনীর চৌধুরীর সঙ্গে একটা ফোন কল আর এসএমএস আদান–প্রদানের মাধ্যমেই এই অনলাইন মিটিংয়ের আয়োজন করে ফেলা গেল। উদ্দেশ্য ছিল, মন্ত্রীকে অবগত করা এই কঠিন সময়ে প্রাইভেট পাবলিক উদ্যোগগুলো কত সুন্দরভাবে এগোচ্ছে কোনো রকম বাধা ছাড়া। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ডেটা অ্যানালাইটিকস দিয়ে করোনা মোকাবিলা করা। সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন, এ রকম সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ দুই বছরেও সম্ভব নয়, যা এই ৬ সপ্তাহে হয়েছে। আরও বড় কথা হলো, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা একসঙ্গে কী সুন্দরভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন, যা আগে ছিল অনেকটা কল্পনাতীত। প্রয়োজন আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। নতুনভাবে কাজ করতে শিখিয়েছে।
দুই সপ্তাহের মধ্যে ২০ হাজার শেয়ারহোল্ডার ধারণ করার মতো একটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে জিপি ভার্চ্যুয়াল এজিএম করে ফেলল ২১ এপ্রিল। এ রকম হাজারো কোম্পানির হাজারো উদাহরণ আছে বদলে যাওয়ার।
টেকনোলজি, ইনোভেশন, কলাবোরেশন ও টেলিকমের হাত ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশের এই একটা ধারা, বদলে যাওয়া, বদলে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া। পুরোনো অভ্যাসগুলোতে আর হয়তো ফিরে যাওয়া হবে না, যাবই–বা কেন, যদি নতুনের মাঝে ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া যায়। এই নতুন স্বাভাবিকতার মাঝে আমাদের ব্যক্তি হিসেবে অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেন ঝরে পড়তে না হয়।
সমাজের প্রতিটি স্তরে নতুন স্বাভাবিকতাকে মেনে নেওয়াটা কি স্বাভাবিক? তা কিন্তু নয়। ঘরে বসে যখন কাজ চলছে, একজন রিকশাচালকের বা দিনমজুরের না খেয়ে থাকা কিন্তু স্বাভাবিক নয়। স্কুল অনলাইন হলেও, স্কুল-কলেজকে ঘিরে অন্য মানুষদের বেঁচে থাকাটা কিন্তু স্বাভাবিকতার বাইরে চলে যাওয়া। আরও শত উদাহরণ তো আছেই। করোনার প্রভাব আমাদের আর্থসামাজিকতায় এক বিশাল ধাক্কা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়েছে একের পর এক আর্থসামাজিক প্রণোদনা নিয়ে। এগুলোর প্রস্তুতি ছিল না। কোটি মানুষের বিনা মূল্যে খাদ্যের জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে অনেকেই এগিয়ে আসছে। গ্রামীণফোন-ব্র্যাক ‘ডাকছে আমার দেশ’ দিয়ে আহ্বান জানিয়েছে সবাইকে একসঙ্গে হাত মেলাতে। ব্র্যাক শুরু করেছিল এক লাখ পরিবারের দুই সপ্তাহের খাদ্যসহায়তা দিয়ে। গ্রামীণফোন দিয়েছে আরও এক লাখ পরিবারের দুই সপ্তাহের খাদ্যসহায়তা। আরও অনেকে যোগ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আমরা সবাই মিলে পথ খুঁজে নেব এই কঠিন সময়টা একসঙ্গে পার করে নিতে।
শুধু নিম্ন আয় আর দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা আছেন তাঁদের জন্যই নয়, অনেক ইন্ডাস্ট্রি যেমন এয়ারলাইনস, হোটেল, পর্যটন, জ্বালানি, আবাসন, গার্মেন্টস, বিনোদন এবং আরও অনেকেই দেখছেন বা দেখবেন কঠিন সময়। দরকার হবে উদ্ভাবনী শক্তি এবং নতুন চিন্তাধারা। আমাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলোও বদলে যাবে। নতুনভাবে তৈরি হতে হবে আমাদের। শহরের স্কুলগুলো অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। এটা কিন্তু বাংলাদেশের সব স্কুল–কলেজের বর্তমান স্বাভাবিকতা নয়। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও অনেকের সঙ্গে পথ খুঁজে নিচ্ছে কীভাবে শিক্ষাকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া যায়। আজকে উন্নত বিশ্বে যা স্বাভাবিক, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশে তাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ সবকিছু আমাদের ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে হবে।
অনেক কিছুই যখন আগের জায়গায় ফেরত যাচ্ছে না, আমরা অনেকেই এখন ভাবতে বাধ্য হচ্ছি এই নতুন স্বাভাবিকতাকে কীভাবে সামনে আরও বড়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব, আমরা হয়তো কেউ কেউ এখানে অনেকটা এগিয়ে আছি। নতুন স্বাভাবিকতা নিয়ে যাঁরা এখনো ভাবেননি, তাঁদের ভাবতে হবে। কিন্তু যাদের জন্য এই স্বাভাবিকতা মেনে নেওয়ার বাইরে, তাদের জীবনটাকে স্বাভাবিকতার মাঝে নিয়ে আসতে হবে, তা না হলে আমাদের নতুন স্বাভাবিকতা হবে ক্ষণস্থায়ী ও অকার্যকর।
নতুন স্বাভাবিকতাকে মেনে নেওয়া অবশ্যই হতে হবে সমষ্টিগতভাবে—কাউকে বাদ দিয়ে নয়। মোবাইল টেকনোলজি, ইনোভেশন, গভর্ন্যান্স, প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ এবং সবার ওপরে আমাদের তরুণসমাজ এবং তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আমাদের প্রমাণ করতে হবে। এই নতুন স্বাভাবিকতাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াটা হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক, ফলপ্রসূ। এবং এটা সম্ভব।
ইয়াসির আজমান: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন লিমিটেড