নিজস্ব প্রতিবেদক,
নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দরিদ্রতা নিরসনে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করে।সম্প্রতি আশার গবেষক অতনু দাস তাঁর লেখায় এ তথ্য তুলে ধরেন। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে কিভাবে দরিদ্রতা বিমোচন করা যায় সে বিষয়ে দেশের অন্যতম বেসরকারী বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান আশা’র গবেষণা ও মূল্যায়ন সেকশন থেকে সম্প্রতি “Fostering the Voices of Women: A Scorecard Approach to Measure the Impact of ASA’s Microfinance Program on Women’s Empowerment in Combating Poverty” শীর্ষক একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এই গবেষণায় গবেষক অতনু দাস নারী ক্ষমতায়ন প্রত্যয়কে কয়েকটি নির্ধারকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, যা হল- নারীদের গতিশীলতা ও যোগাযোগ, সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রন ও মালিকানা, পারিবারিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ এবং নারীদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান এবং আত্মনির্ভরতা। তাঁর গবেষণায় দেখা যায়, নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নারী শিক্ষা, স্বামীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ব্যবধান তুলনামূলক কম থাকা, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংযুক্ততা, স্বনিয়োজিত কাজে স্বামীদের নিয়োজিত থাকা, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে নারীর অধিগম্যতা, নারীর নিজস্ব সঞ্চয় এবং প্রশিক্ষিত হওয়া। নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হল নারী শিক্ষার প্রতি অনীহা, দরিদ্রতা এবং সাংসারিক কলহ। এই গবেষণা আরও নির্দিষ্ট ভাবে তুলে ধরে যে, নারী ক্ষমতায়নের হার নন-বরোয়ারদের চেয়ে আশার ঋণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ১.৩ ইউনিট বেশী, অর্থাৎ নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আশার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গবেষণার গবেষক মি. দাস বলেন আশার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নারী সদস্যাদের প্রথাগত গৃহিনী’ অবস্থানকে ৪ ভাবে পরিবর্তন করেছে; প্রথমত একজন উদ্যোক্তা হিসাবে, দি¦তীয়ত পরিবারের ব্যবসা ও কৃষিতে একজন মুলধন সরবরাহকারী হিসাবে, তৃতীয়ত পরিবারের জরুরি প্রয়োজনের সময় অর্থ সরবরাহকারী হিসাবে এবং সর্বশেষ একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসাবে।
দরিদ্রতার কারণ হিসাবে মি. দাস কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বহীনতা, নিরক্ষরতা, পরিবারে অধিক সদস্য সংখ্যা, কর্মমুখী এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের অভাব, সঞ্চয়ের প্রতি অনীহা, ভৌগলিক অবস্থান, জমির মালিকানা না থাকা এবং দাম্পত্য কলহ। দরিদ্রতা সংক্রান্ত বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, আশার ঋণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে দরিদ্রতার হার নন-বরোয়ারদের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম, যা আশার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্রতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে তুলে ধরে।
নারী ক্ষমতায়ন কিভাবে দরিদ্রতা নিরসনে ভূমিকা পালন করে সেটি বিশ্লেষণে এই গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দরিদ্রতার হার নারী ক্ষমতায়নের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রায় ৬ শতাংশ হারে হ্রাস পেতে থাকে। তাই মি. দাস নারী ক্ষমতায় কে দরিদ্রতা নিরসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করার উপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আশার ঋণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার ফলে নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দরিদ্রতা বিমোচনের হার প্রায় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ফলে অংশগ্রহণকারী নারীদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি তাদের পরিবারের দরিদ্রতা বিমোচনের গতিও তরান্বিত হয়। এই গবেষণায় গবেষক মি. দাস নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব প্রদান করার সুপারিশ করেছেন, যেমন- নারী শিক্ষার জন্য শিক্ষাঋণ, নারীদের জন্য কর্মমূখী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে ঋণের টাকা নিজেরাই ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত করে তোলা, ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত ঋণ প্রোডাক্টের ব্যবস্থা করা, নারীদের সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলা, নারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের মধ্যস্থতা করা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, এই গবেষণা গ্রন্থটি মি. দাসে ৫ম গবেষণা গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য গবেষণা গ্রন্থগুলো ক্ষুদ্রঋণ, দারিদ্র, সম্পূরক শিক্ষা কর্মসূচির প্রভাব এবং শিক্ষার্থী ড্রপআউট এর উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। উল্লেখ্য গবেষণা গ্রন্থ সমূহ ছাড়াও তাঁর বিভিন্ন গবেষণা দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু হল- রজনীগন্ধা চাষীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মারমা আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এনজিও পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র সমূহের ভূমিকা, হাওড় এলাকার অধিবাসীদের উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা, ক্ষুদ্র কৃষকদের প্রতিবন্ধকতা এবং তাদের উত্তরনের উপায় ইত্যাদি। বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকাও সমভাবে আলোচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হল নারী। এই গবেষণায় গবেষক হিসাবে দায়িত্বপালন করেছেন আশার গবেষক জনাব অতনু দাস। গবেষণাটি বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় পরিচালিত হয়েছে, যেগুলো হল: যশোর, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, নড়াইল, নরসিংদী, নোয়াখালী, পঞ্চগড়, পটুয়াখালী, সিলেট ও ঠাকুরগাঁও। বহুল ব্যবহৃত Randomized Controlled Trial (RCT) পদ্ধতিতে পরিচালিত এই গবেষণায় মোট ১৩৬৬ জন উত্তরদাতার সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়, যাদের সকলেই নারী।
এল/এল