ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটে। চালকের ঘুমিয়ে পড়া বা স্টেশনমাস্টারের ভুল সিগন্যালসহ নানা কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে কসবা ও নরসিংদীর দুর্ঘটনা অন্যতম। তাই এবার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে ট্রেন দুর্ঘটনা ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। এ জন্য স্থাপন করা হবে অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন সিস্টেম (এটিপিএস)। চালক ঘুমিয়ে পড়লেও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে ব্যবস্থা রয়েছে এটিপিএস ব্যবস্থায়। উন্নত বিশ্বে এ ব্যবস্থা আগেই চালু হয়েছে। দেশের ট্রেনে এ অত্যাধুনিক যন্ত্র স্থাপন বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে গতকাল মঙ্গলবার বৈঠক হয়।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ট্রেনের সুরক্ষা সম্ভব বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। রেলওয়ের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান বলেন, এটিপিএস ট্রেন সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে সমীক্ষার জন্য যেসব প্রস্তাবনা এসেছে তার কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে হবে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশে ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৫ বছরে ৯৪৫টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৪১ জন নিহত এবং ৩৮৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১২৯টি দুর্ঘটনাই ঘটে ২০১৯ সালে।
রেলের অপারেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৭৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ট্রেনের লাইনচ্যুতির কারণে। ৭০২ বার লাইনচ্যুতির মধ্যে ৩৪৯টি ঘটেছে অতিরিক্ত গতি ও অসাবধানতার কারণে। তা ছাড়া ভুল অপারেশন তথা ভুল সিগন্যালের কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। রেলের ভাষায় একে বলে ওভারস্যুট বা ভায়োলেন্স। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষাব্যবস্থা চালুর জন্য সমীক্ষা প্রস্তাব হাতে নিয়েছে রেলওয়ে। এর মনুষ্য ভুলে সিগন্যাল অমান্য এবং গতি নিয়ন্ত্রণ নির্দেশনা অমান্য করাসহ অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পরিবহন সংস্থা রেলওয়ে বছরে ১২ কোটি ৯০ লাখের বেশি যাত্রী পরিবহন করে। পুরনো অবকাঠামো, ট্র্যাক, ব্রিজ, রোলিংস্টক, সংকেত ব্যবস্থা ইত্যাদির সীমাবদ্ধতার কারণে নিরাপদ যাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তা ছাড়া অপারেশন বিভাগের জনবল সীমাবদ্ধতা, ইঞ্জিন-কোচের রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতিও দুর্ঘটনার কারণ। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- জনবলের ঘাটতি। স্টেশনমাস্টার, লোকোমাস্টার, পয়েন্টসম্যান ও সিগন্যাল মেইনটেনারদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়। ফলে তাদের অসাবধানতা বা অবহেলার কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে- গতি অতিক্রম করে মুখোমুখি ট্রেন সংঘর্ষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সমস্যা সমাধানে ট্রেন পরিচালনার ত্রুটি চিহ্নিত করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি ও অপারেশনাল বিষয়ে নজর দিতে হবে। তা ছাড়া স্টেশনের সিগন্যালিং সিস্টেম সিটিসি, সিবিআই, রিলে মেকানিক্যাল ও নন-ইন্টারলকড সিস্টেমে নজর দিতে হবে। সর্বোপরি ট্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যন্ত্রের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গত বছরে কসবার মন্দবাগ ট্র্যাজেডি অন্যতম রেল দুর্ঘটনা। তূর্ণানিশীথা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ১৬ জন নিহতসহ আহত হন অর্ধশতাধিক যাত্রী। এর আগে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৯ সালে। টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন আউটারে এ দুর্ঘটনায় ১৭০ জন নিহত হন। একই বছর চট্টগ্রামে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নিহত হন ১৩ জন। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরের হিলি স্টেশনে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হন ৫০ যাত্রী। ২০১০ সালে নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ‘মহানগর গোধূলি’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’র সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হন। এর মধ্যে অনেক দুর্ঘটনাই মনুষ্য ভুলের কারণে ঘটেছে মনে করে রেল কর্তৃপক্ষ।