জেলা প্রতিনিধি:
নিজ অর্থায়নে গণকবর বানিয়ে আড়াই হাজার পরিবারের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এসব পরিবার থাকছে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরের সড়কের পাশে। মেঘনা নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে সড়কের পাশেই ঠাঁই মেলে তাদের।
আড়াই হাজার পরিবারের ১০ হাজার ভূমিহীন মানুষের জন্য লক্ষ্মীপুর সদরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের সুতারগোপ্তা এলাকায় সাড়ে ২৯ শতাংশ জমিতে বানানো হয়েছে এ গণকবর। পাশেই রয়েছে মসজিদ, অজুখানাসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা।
গণকবর পেয়ে খুশি এখানকার বাসিন্দারা। তারা জানান, মেঘনা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে রামগতি-কমলনগরের সড়কের পাশে থাকছেন তারা। এখানে আসার পর অনেক স্বজনকেই হারিয়েছেন। কিন্তু কবরের জায়গা না থাকায় সবার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর পর দাফনের জায়গা না থাকায় প্রতিনিয়তই কষ্ট পোহাতে হতো তাদের।
জানা গেছে, সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের কাছ থেকে পশ্চিম চরমনসা গ্রামে সাড়ে ২৯ শতাংশ জমি কেনে পুলিশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জমিটির রেজিস্ট্রি করা হয়। এরপর পুরো জমিতে সীমানা প্রাচীর তুলে শুরু হয় কবরস্থান ও মসজিদ নির্মাণের কাজ। সেখানে গভীর নলকূপ, লাশ গোসল ঘর ও শৌচাগার রয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে গণকবরে যাওয়ার জন্য সংস্কার করা হয়েছে রাস্তাও।
এক বছর ধরে এর রক্ষণাবেক্ষণ, মসজিদসহ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ শেষে গণকবরের রূপ দেয় লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ। এটি স্থাপনের পর নদীভাঙন কবলিত ভূমিহীন এসব মানুষ বেশ খুশি। মৃত্যুর পর বিনা খরচে এখানে চিরসমাপ্তির ঠাঁই হবে তাদের। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তারা। ভবানীগঞ্জ ও তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের ভূমিহীনরাও ঠাঁই পাবে এখানে।
ভূমিহীন আব্দুল্যাহ জানান, বিভিন্ন সময় তাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে দাফন করার মতো কোনো জায়গা পেতেন না। কাউকে অন্যের জায়গায় কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। স্বজনের কবরের পাশে গিয়ে দোয়া করার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। এখন গণকবর পেয়ে তিনি অনেক খুশি। মরেও আত্মার শান্তি পাবে বলে জানান তিনি।
আইয়ুব আলী, ইমন ব্যাপারীসহ একাধিক ভূমিহীন জানান, স্বজন হারানোর বেদনার চেয়েও তাদের কাছে বেশি চিন্তার বিষয় কবরের জায়গা না থাকা। মৃত্যুর পর অনেক সময় লাশ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। কোথায় কার জমিতে দাফন করা যাবে তা নিয়ে সবসময় কাজ করতো অস্থিরতা। কারো মৃত্যু হলে শুরু হতো ছোটাছুটি। এছাড়া নিজেদের কবরস্থানে অন্যের কবর দিতেও অনীহা জানাতেন অনেকে। এতে নদীভাঙা বাসিন্দাদের শেষ যাত্রা হতো বিড়ম্বনার। লাশ ভাসিয়ে দিতেন নদীতে।
ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল হাসান রনি বলনে, রামগতি-কমলনগর সড়কের দু-পাশে বসবাসকারীরা বাস্তুহারা। কোনোমতে অস্থায়ীভাবে তারা এখানে থেকে জীবনযাপন করছেন। তাদের জন্য আধুনিক কবরস্থান ও মসজিদ নির্মাণ করে ইতিহাস রচনা করেছেন আইজিপি বেনজীর আহমেদ।
লক্ষ্মীপুরের এসপি ড. এএইচএম কামরুজ্জামান বলেন, কেউ মারা গেলে করব দেওয়া নিয়ে নদীভাঙা মানুষের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। এমন সংবাদে আমাকে পদক্ষেপ নিতে দায়িত্ব দেন আইজিপি। তার নির্দেশে জমি কেনার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে একটি কবরস্থান, মসজিদ, লাশ গোসল করানোর ঘর ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়। শুধু তাই নয়, একটি গভীর নলকূপও বসানো হয়েছে।
৫ অক্টোবর গণকবর ও মসজিদের ফলক উন্মোচন করেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পুনাক সভানেত্রী ও আইজিপির স্ত্রী জীশান মির্জা। পরে গণকবর পরিদর্শন ও গাছ রোপন শেষে ওইদিন মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ড. বেনজীর।
সভায় আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, এ দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমান, পেট ভরে খান, কিন্তু মারা যাওয়ার পর শেষ ঠাঁই কবরস্থান থাকবে না কিংবা হবে না এটা হতে পারে না। মৃত্যুর পর যেন শেষ ঠিকানায় দাফন করা হয় সেজন্যই কবরস্থান করে দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো কবরস্থানসহ ভূমিহীন মানুষের সন্তানদের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করা হবে।