রেনেকা আহমেদ অন্তু: বিশ্বব্যাপী দিন দিন নগরায়নের প্রসার বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশী মানুষ শহরে বসবাস করছে। তবে নগর পরিকল্পনায় আজো নেই সকলের সমান অধিকার, নেই মানবিক অন্তর্ভুক্তিকরন সুস্পষ্ট কার্যকরী পলিসি । ২০১৯ সালের তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৭ ভাগেরও অধিক প্রতিবন্ধী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৭ লাখেরও মতো। এদের কেউ কেউ জন্মাগত প্রতিবন্ধী, কেউ কেউ আবার দুরারোগ্য ব্যাধি, দুর্ঘটনা কবলিত প্রতিবন্ধী। এদের জীবনে পথচলা সহজ নয়, পৃথিবীর নানা রঙ, রূপ ,বিলাস-বৈচিত্র্য অনেক কিছুতেই তাদের নেই প্রবেশাধিকার; যেন ধরেই নেয়া হয় এসব তাদের জন্য অতটা আবশ্যক নয়। সাহসী কন্যা (যুব নেটওয়ার্ক) এমন অসামাঞ্জস্য রূঢ বাস্তবতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। সাহসী কন্যা নারীবান্ধব নিরাপদ নগরায়নে সকলের অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিতকরণের বাস্তবচিত্র অনুধাবনের উদ্দেশ্যে ঢাকার তিন প্রতিবন্ধী কর্মজীবি নারীর জীবনের গল্প সংগ্রহ করে। তাদের জীবনের রোজকার অভিজ্ঞতার আলোকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে রাজধানীতে চলমান জনস্থানগুলোতে প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের কতটা প্রবেশাধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে সে বাস্তবতার চিত্র। সাহসীকন্যার এ কার্যক্রমটি গার্লস গেট ইকুয়াল ফ্রিডম ইন পাবলিক স্পেসেস- সেফার সিটিস ক্যাম্পেইনের অংশ ছিল।
সানজিদা আক্তার
ঢাকায় বসবাসরত সানজিদা আক্তার জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী। সানজিদা, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতকত্তোর ডিগ্রি নেন। পরিবারের আদরের ২৯ বছরের সানজিদা ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। শিক্ষাজীবনে প্রথম সারির ছাত্রী হিসেবেই ছিলেন পরিচিত। যদিও অনেকসময়ে হেলার পাত্র হবার অভিজ্ঞতাও তার আছে।আলাপের এক পর্যায়ে শেয়ার করেন নিজের কেজিতে পড়ার সময় একবার পরীক্ষায় প্রথম হয়েও প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবার কথা। বর্তমানে সানজিদা কর্মরত আছেন একটি বেসরকারী সংস্থার কমিউনিকেশন অফিসার হিসেবে। রোজ গনপরিবহনেই যাতায়াত করেন বাসা থেকে কর্মস্থলে। আমাদের রাজধানীর জনস্থান কতটা প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের জন্য প্রতিকূলতায় আড়ষ্ট তার কিছু অভিজ্ঞতা তিনি সাহসী কন্যার সাথে শেয়ার করেন। সানজিদার কাছে গনপরিবহনে যাতায়াত রোজকার এক সংগ্রাম, যেখানে জয়ী না হওয়া ব্যতীত অন্য বিকল্প ভাবার সুযোগ থাকে না তার! যাত্রী কিংবা গাড়িচালক, কারো না কারো সাথে জোরালো কন্ঠে কথা বলেই গনপরিবহনে নিজের অংশগ্রহন নিশ্চিত করেন তিনি রোজ।
সড়কে চলাচলের এক অভিজ্ঞতায় শেয়ারের সময় সানজিদা বলেন- “একজন শারীরিক প্রতিবন্ধিব্যক্তি হিসেবে আমার হাঁটা-চলার দ্রততা অন্য সাধারন মানুষের থেকে তুলনামূলক একটু কম। আমার উচ্চতাও তুলনামূলক অনেক কম। একবার রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে বাড্ডায় রাস্তা পারাপারের সময় আমি প্রায় এক গাড়ির নীচে এসে পরেছিলাম। সৃষ্টিকর্তায় কৃপায় সে যাত্রায় কিছু হয় নি। পথের লোকজন যখন গাড়িচালককে বকাবকি করছিল তখন তিনি চালক বলেছিল যে- তিনি দূর থেকে আমাকে লক্ষ্যই করেন নি। আমি নিজেও ব্যাপারটির সাথে একমত। অনেক সময় উচু গাড়ি থেকে আমার মতো চার ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার কাউকে চোখে না পড়াটা অবাস্তব নয়। রাজধানীতে কতশত ফ্লাইওভার হয়। কখনো কি রাস্তাপারাপারে আমাদের মতো মানুষের কথা চিন্তা করে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়? সড়ক দূর্ঘটনা ঠেকাতে ফুটওভার ব্রিজ হয়, তবে অন্তর্ভুক্তিকরন নিশ্চিতের জন্য জেব্রাক্রসিং এর সংখ্যা কি বাড়ানো হয়?” তিনি নগরের জনস্থানগুলোকে প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার প্রদানে অনেকটা একচোখা বলে নিজের বক্তব্যে প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চালক জানান- “এমনিতেই আমাদের ফুটপাতগুলো সরু, একদমই ঊইলচেয়ার ব্যবহারপযোগী নয়। তার উপর ইদানিং গ্যারেজ থেকে গাড়ি চলাচলের জন্য বাড়ির সামনে ঢালু করে নেয়ার চল বেড়ছে! ভেবে দেখেছেন সেইটুকু পথ কিভাবে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীব্যক্তি পার করে?” সানজিদার কাছে নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান-“নগর কখনো মুষ্টিমেয় মানুষের সুবিধার্থে গড়ে উঠতে পারে না। দেশে প্রতিবন্ধীব্যক্তিরা সংখ্যালঘিষ্ঠ বটে, তাই বলে জনস্থানে তাদের অনূকুল প্রবেশাধিকার থাকবে না তা হতে পারে না। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পার্ক-লেকের প্রবেশ পথ, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদি সকল জনস্থান অন্তর্ভুক্তিকরন ভাবনায় ডিজাইন ব্যাতীত কোনো নগর কখনোই সমাজের সকলের জন্য নিরাপদ কিংবা নারীনান্ধব নগর নয়।”
সুমনা খান
ঢাকায় বসবাসরত সুমনা খান জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী। বর্তমানে ২৭বছর বয়সের সুমনা পরিবারের সকলের আদরের হলেও সমাজ থেকে ছোটবেলা থেকেই তাকে নানা বাধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্কুলজীবনে শিক্ষকদের মন জয় করতেও তাকে সবসময় অন্যদের থেকে বাড়তি চেষ্টা দিয়ে আসতে হয়েছে, যাতে কখনোই সমাজ তাকে পেছনে রেখে যাবার উছিলা না পান। শতবাধাতেও তার জীবনে স্বাবলম্বী হয়ে পথচলার সংগ্রাম থেমে যায় নি। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়েই শেষ করেছেন ইডেন কলেজ থেকে ইংরেজী বিভাগে স্নাতকত্তোর। ইতিমধ্যে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন কিছু বেসরকারি সংগঠনে। বর্তমানে পার্টটাইম ভয়েসওভারের কাজও করেন। পেশাগত ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সুমনা খান অহরহ যাতায়াত করেন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে।
তিনি জানান- “আমাদের দেশের গনপরিবহনগুলোর ডিজাইনই করা হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা না ভেবে। ধরেই নেয়া হয়েছে যে, প্রতিবন্ধী মানুষদের রোজ যানবাহন ব্যবহারের প্রয়োজন পরে না। অথচ কোনো চাকুরিতে তো আর প্রতিবন্ধিদের কেবল যাতায়াতের জন্যই বাড়তি পয়সা দেয়া হয় না! অতএব, যে দেশে বর্তমানে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার, সেই দেশে চাকুরী পেলেও রোজ অফিস এর যাতায়াত খরচ মিটিয়ে কতটাকা ঘরে আনা যাবে এটা প্রতিবন্ধী কর্মজীবী মানুষদের চাকুরীতে জয়েনের পূর্বেই ভাবতে হয়, কখনো কখনো চাকুরি পেয়েও ছাড়তে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এমনিতেই নারীদের বিনোদনে ঘরের বাহিরে যাওয়াটা ‘ভালো চোখে’ দেখা হয় না। প্রতিবন্ধী নারীদের বিনোদন নিয়ে তো সেখানে নগরের ভাবনা নেই বললেই চলে! এজন্যই দিন দিন নগরে সুস্থ সামাজিক জীবন নিশ্চিকরনের জন্য বিনোদনের পার্ক, মাঠ ইত্যাদি নির্মান হলেও তা কতটা প্রতিবন্ধীব্যক্তিবান্ধব তা নিয়ে তেমন জোরালো প্রতিবাদ গড়ে উঠে না।”
সুমনা খানের কাছে নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান- “যে শহরের পরিকল্পনায় সকল শ্রেনীর মানুষের জন্য সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে, থাকে না পথে-ঘাটে শারীরিক/মৌখিক যৌনসন্ত্রাস, যে শহরের গনপরিবহনগুলো কেবল সংখ্যা গরিষ্ঠদের কথা না ভেবে সকলের প্রবেশাধিকারের কথা ভেবে তৈরি হয়েছে; সে শহরই আমার কাছে নিরাপদ শহর।”
আকলিমা খাতুন
২০০৫ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত মেহেরপুরের আকলিমা খাতুন আজীবনের জন্য দুপায়ে ভর করে চলাচলের সামর্থ্য হারান। পরিবারের অনেকের কাছেই এজন্য হয়েছেন হেলার পাত্র। সমাজের অনেকের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত পড়াশোনা ছেড়ে দেবার নানা যুক্তির সাক্ষ্যীও হয়েছিলেন। তবুও হার মানেন নি। কখনো কখনো শিক্ষকদের সহযোগিতা পেয়েছেন, কখনো কখনো হয়েছেন অ্যাডমিনিস্টেশনের গাফলতির শিকার। কখনো নীচতলায় পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেয়েছেন, কখনো চারতলায় গিয়েও পরীক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানে সহকারী শিক্ষক হিসেবে রায়পুর প্রাইমেরি স্কুলে চাকুরী করছেন। নগরের যাতায়াতে আকলিমা খাতুন অহরহ শিকার হয়েছেন নানা মৌখিক হ্যারাসমেন্টের, শুনছেন নিজের দূর্ঘটনাজনিত “শারীরিক প্রতিবন্ধকতা” নিয়ে নানা কটু কথা।
প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের নগরের জনস্থানের বাস্তবতা কেমন এ প্রশ্নে আকলিমা খাতুন অন্য দুইবক্তা সুমনা এবং সানজিদার কথার সাথে একমত। তিনি আরো যোগ করে বলেন- “প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার জনস্থানে সবসময় তুলনামূলক নানা প্রতিকূলতায় জড়জড়িত। আমাদের দেশ ডিজিটাল হচ্ছে। তবে এখনো প্রায়ই সড়কেরই সিসিটিভি ক্যামেরা প্রায়ই অকেজো দেখা যায়। এর ফলে ছিনতাই এর হার দিনদিন বাড়ছে। এতে প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের ভোগান্তি বাড়ে আরো বেশি। পার্ক, রোড যেকোনো জায়গায় তাই প্রতিবন্ধীব্যক্তিরা ছিনতাই, চুরির তুলনামূলক বেশি শিকার হচ্ছেন। মিলছে না সুবিচারও।” আকলিমার কাছে নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া হলে
তিনি জানান- “সুনির্দিষ্ট, ব্যাখ্যামূলক আইনের সুশাসন নগরের নিরাপত্তাবৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। বিশেষত নারীদের বিরুদ্ধে ঘটা যৌনসন্ত্রাস রোধে আইনের সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিকরন নারীবান্ধব নগর গড়তে সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতাবৃদ্ধির ও আবশ্যকতা আছে।”
লেখক- নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।