আইন প্রণেতা যদি আইনের পথে না চলেন তবেই অনাবশ্যক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেইটাই হয় আমাদের এখানে, বেশি করেই হয়। ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন নির্বাচনী বিধির বিষয়ে কঠোর হতে চাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের ক্ষেত্রে কমবেশি সব পক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠছে।
তবে নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজের জায়গায় স্থির থাকতে পারছে কি না তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় একাধিক প্রার্থীকে শোকজ ও সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন মনে হচ্ছে পুরোপুরি স্থির হতে পারছে না কমিশন।
প্রথমেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে ঠিক কখন থেকে আচরণবিধি কার্যকর হয়, তা নিয়ে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর ১৮ ডিসেম্বরের আগে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার আইনগত সুযোগ নেই। ফলে এর আগে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই।
তাই, বিভিন্ন দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তারা এখন নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন কি না, তা পরিষ্কার হলো না। কিছুদিন আগে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা প্রয়োগের সময় এখনো আসেনি। নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর আচরণ বিধিমালা প্রযোজ্য হবে।
আবার আমরা দেখলাম, এর মধ্যে কমিশন কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযুক্ত করেছে। এটি কমিশনের মধ্যকার সংশয়কে সামনে নিয়ে আসছে।
সাবেক অনেক নির্বাচন কমিশনার বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনী সব আইন ও আচরণবিধি প্রযোজ্য হয়। সেই বিবেচনায় নির্বাচন কমিশনকে এখনই শক্ত হাতে আচরণবিধি প্রয়োগে উদ্যোগী হতে হবে।
একদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে, ১৮ ডিসেম্বরের পর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে আচরণবিধি প্রযোজ্য হবে। বিপরীতে শোডাউন ঘিরে অনেক প্রার্থীকেই এরই মধ্যে তলব করা হয়েছে ইসিতে, পাঠানো হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ)। আবার অনেকে দৃষ্টিকটু শোডাউন করলেও তাকে কিছু করা হচ্ছে না।
কমিশনের এমন স্ববিরোধী আচরণের সমালোচনা হওয়ায় কমিশন এখন বিশিষ্টজনদের ওপর নাখোশ হয়েছে। রীতিমতো লিখিত বিবৃতি দিয়ে ইসি বলছে, বিশিষ্টজন মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন।
২ ডিসেম্বর ২০২৩ কমিশনের জনসংযোগ শাখা থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের টকশো এবং পত্রপত্রিকায় কতিপয় বিশিষ্টজন মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে প্রচারিত বিশিষ্টজনের এমন মনগড়া বক্তব্য জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে। এতে ইসির ওপর জনগণের আস্থা বিনষ্টের মাধ্যমে নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বিষয়টি মোটেও কাম্য নয়।
শুরুর দিকে নির্বাচন কমিশন বলল, এমপিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে পদত্যাগ করতে হবে। কমিশনের একজন সদস্য এমনটা বলেছিলেন। তবে পরদিনই আবার বলা হয়েছে, পদত্যাগের প্রয়োজন হবে না। এছাড়া প্রশাসনের রদবদল এবং আচরণবিধি নিয়ে ইসির শীর্ষ কর্তাদের এক ধরনের মন্তব্যের বিপরীতে সিদ্ধান্ত হয়েছে অন্যরকম। ফলে জনমনে দেখা দিয়েছে এক প্রকার বিভ্রান্তি।
তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আচরণবিধি প্রযোজ্য, এমনটাই আমরা জেনে এসেছি। কারণ নির্বাচন-পূর্ব সময় এই বিধিমালায় সংজ্ঞায়িত করা আছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ পর্যন্ত সময়কে নির্বাচন-পূর্ব সময় বোঝায়। আর যদি কমিশন মনেই করে যে, এখন প্রযোজ্য নয়, তাহলে বেশকিছু প্রার্থীদের সতর্কতার প্রয়োজনই বা হলো কেন?
গণমাধ্যমে রিপোর্টও হচ্ছে যে, আচরণবিধি ভেঙে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া হয়েছে, অনেকে জমা দিতে এসেছেন প্রটোকল ব্যবহার করে। অনেকে, বিশেষ করে নৌকা প্রার্থীদের অনেকেই আবার মনোনয়ন পত্র জমা শেষ করেই এলাকায় মেয়র চেয়ারম্যানদের সাথে মতবিনিময় করতে শুরু করেছেন।
এই রকম অভিযোগের ঠিক সংখ্যা বলা যাবে না। তবে প্রতিদিনই তা নিয়ে অভিযোগ আসছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী, সরকারি যেকোনো সম্পত্তিকে প্রচারের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট দলকে প্রথমে তা জানানো হয়, অথচ তা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই করতে দেখছি না। অনেকেই নানাভাবে প্রচারণাও চালাচ্ছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮-এর ১২ ধারা অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা দল মনোনীত ব্যক্তি বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ আগে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না।
এগুলো নির্বাচন কমিশনকে দেখতে হবে। যারা এর সমালোচনা করছেন তাদের বিরোধিতা করা নির্বাচন কমিশনের সাজে না। একটা কথা সবাই জানে যে, সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী, আগের সংসদ সদস্য আর সরকারি দল করা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আচরণ মানানো কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। ভোটের আগেই যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, ভোটের সময় যে কী হয় তাই ভাবনার বিষয়।
তবে আচরণ মানানো শুধু নির্বাচন কমিশনের একার কাজ নয়। প্রার্থী এবং দল সবার সহযোগিতা না পেলে কমিশনের পক্ষে কাজ করা কঠিন। আচরণবিধি সেইটা শুধু প্রার্থী নন, রাজনৈতিক দলের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ এর নামই হলো রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা। এই আচরণবিধি এবং প্রশাসনের রদবদল বিষয়ে কঠোরতা না দেখাতে পারলে একটা পর্যায়ে গিয়ে কমিশনকে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। প্রার্থী এবং দল সবাইকে মনে রাখা দরকার যে, শুধু বিধি দিয়ে সবকিছু হয় না, নিজেদের আচরণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বিএসডি / এলএম