নিজস্ব প্রতিবেদক: কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে তড়িঘড়ি করে পালালেন মোসারাত জাহান মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম আয়োজিত এক সম্মেলনে এই ঘটনা ঘটে। বেলা ১২টায় শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, কিভাবে একজন কলেজ পড়ুয়া তরুণী এত অভিজাত জীবন যাপন করেছেন? তার আয়ের উৎসই বা কি ছিল? কাদের সাথে তার সখ্যতা ছিল? এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য নুসরাতের জাতীয় পরিচয়পত্র কেন ব্যবহার করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের জবাবে রীতিমতো বিব্রত বোধ করেন নুসরাত। একপর্যায়ে তিনি বলতে বাধ্য হন তার বোন অবাধ্য ছিলেন। তিনি বলেন, মুনিয়ার এসব আচরণ মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। বোনকে তো আর ফেলে দিতে পারি না! তিনি বলেন, আমি পরাজিত ছিলাম। সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের ঘরে এমন কেউ থাকলে আপনারা তাদের অস্বীকার করতে পারবেন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক হুইপ পুত্র শারুনের সঙ্গে তার নানা চ্যাটিং এর বিষয়ে প্রশ্নে নীরব ছিলেন নুসরাত। সদুত্তর মিলেনি শারুনকে অভিযুক্ত করে তাদের একমাত্র সহোদর ভাইয়ের মামলার আবেদনের বিষয়েও। এই বিষয়ে বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের গ্যাপ রয়েছে। জানতে চাওয়া হয় মুনিয়ার চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সংগে সম্পর্ক নিয়েও। নীরব থাকেন নুসরাত।
বর্তমানে মামলাটির তদন্তের কাজ চলছে। পুলিশের তদন্তে একে একে বেড়িয়ে আসছে মাদকসক্ত মুনিয়ার বেপরোয়া জীবনের বিভিন্ন কাহিনী, মিলছে ঘটনার সঙ্গে হুইপপুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের সম্পৃক্ততা ঠিক তখনই পুলিশকে দোষারোপ শুরু করেছেন নুসরাত। খোদ মামলার বাদী নুসরাত জাহানই চোর বানালেন পুলিশকে। এসময় নুসরাত জাহান পুলিশকে বিতর্কিত করতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলে, পুলিশের বর্তমান আচরণে মামলার সঠিক তদন্ত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছি আমরা।
বিলাস বহুল দামি জিপ গাড়িতে করে কুমিল্লা থেকে এসেছেন, কয়েকদিন ব্যবহার করতে দেখা গেছে? এত দামি গাড়ি কার জানতে চাইলে বলেন, সদুত্তর না দিয়ে বলেন, একজন ইনসপেকটরের। কিন্তু নাম জানাতে অস্বীকার হরেন। ইনসপেকটর গাড়ি কোথায় পেলেন এমন আরো নানান প্রশ্ন করা হলেও উত্তর না দিয়ে এক পর্যায়ে মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্টু বিচার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন ত্যাগ করেন তারা।
এখন পুলিশকেই দোষারোপ নুসরাতের
রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে গত ২৬ এপ্রিল বিকেলে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল পুলিশ। গভীর রাতে মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের একটি বৃহৎ শিল্পীগোষ্ঠীর এমডির বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে মামলা নেয় পুলিশ। বর্তমানে মামলাটির তদন্তের কাজ চলছে। কিন্তু পুলিশের তদন্তে যখন একে একে বেড়িয়ে আসছে মাদকসক্ত মুনিয়ার বেপরোয়া জীবনের বিভিন্ন কাহিনী, মিলছে ঘটনার সঙ্গে হুইপপুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের সম্পৃক্ততা- ঠিক তখনই পুলিশকে দোষারোপ শুরু করেছেন নুসরাত। আইনানুযায়ী সবকিছু করার পরও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে একপর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন শেষ না করেই প্রেসক্লাব ত্যাগের চেষ্টা করেন নুসরাত। পরে প্রেসক্লাব ভবনের নিচে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। এসময় নুসরাত জাহান পুলিশকে বিতর্কিত করতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলে, পুলিশের বর্তমান আচরণে মামলার সঠিক তদন্ত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছি আমরা।
টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ধস্তাধস্তি গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাটে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হওয়ার মোসারাত জাহান মুনিয়া হত্যার বিচার চেয়ে করা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকদের মধ্যে ধস্তাধাস্তি হয়েছে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে। হত্যা মামলার আসামি জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নামে একটি সংগঠন এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বলে সূত্রের তথ্য। এর প্রমাণও মিলেছে সংবাদ সম্মেলনের পরে।
অনুষ্ঠান শেষে জাতীয় প্রেসক্লাবে পিছনের গেটে কয়েকজন জড়ো হয়ে সংগঠনের এক নেতার কাছে টাকার ভাগ দাবি করলে- জবাবে তিনি বলেন- আমি যা পেয়েছি তা আপানাদের ভাগ করে দিয়েছি। আমাকে কি আপনারা বিশ্বাস করেন না। তখন পিছনে থাকা এক নারী বলে উঠেন কিভাবে বিশ্বাস করি। যা কথা হয়েছিল তা তো পাইনি। এ সময় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের এক সদস্য বলেন, আমাদের এখানে আনার আগে বলা হয়েছিল মাথাপিছু ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শেষে টাকা পেয়েছি মাত্র ৫০০টাকা। শুনেছি শারুণ সাহেব লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে আজকের সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরে। অন্যায়ের বিচার চাইতে গিয়ে আমরাই বড় অন্যায়ে স্বীকার।
আরো জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়া অধিকাংশই ছিল বহিরাগত। এমনকি রাজাকারদের সন্তান ও জামায়াত-শিবির সদস্য নিয়ে এমন সংগঠন গড়েছেন। শারুনের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ পেয়ে এমন অনুষ্ঠান আয়োজন করেন তিনি। প্রকৃত অর্থে টাকার লোভে এমন আয়োজন করেছেন বলে তার সহযোগীরা জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলন নিয়ে ক্ষব্ধ মুনিয়ার ভাই সবুজ
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাংবাদিক সম্মেলন রহস্যজনক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের জন্য হুইপ পুত্র শারুনের টাকায় এই সাংবাদিক সম্মেলন বলে মন্তব্য করেছেন মৃত মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। মোশরাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় ওই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনের বিষয়টি আপন বড় ভাইকেও আগে থেকে জানানো হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পর লোক মুখে শুনে বিষ্ময় প্রকাশ করেন সবুজ। তিনি বলেন, আমার বোন মারা গেছে, আর আমিই জানতে পারলাম না সাংবাদিক সম্মেলনের কথা। কারা এই সংবাদিক সম্মেলন করেছেন কি তাদের উদ্দেশ্য! আমার চেয়ে তাদের কষ্ট বেশি হয়ে গেলো! অতি ভক্তি কিন্তু চোরের লক্ষণ।
সবুজ বলেন, আমার বোন মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে। আত্মহত্যার প্ররোচণার মামলাটি গুলশান থানায় তদন্তাধীন রয়েছে। এমন অবস্থায় অতি উৎসাহী তৎপরতা খুবই রহস্যজনক। তিনি বলেন, পুলিশের উপর চাপ তৈরি করতে এবং আমার দায়েরকৃত হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের জন্য এই অপচেষ্টা করা হয়েছে। আমি মামলা দায়ের করার পর থেকেই ওই পক্ষটি তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা মনে করছে, ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে নিতে পারলে প্রকৃত হত্যাকারি (শারুন) বেঁচে যাবেন। তাই তাদের এই অপতৎপরতা। আমার কাছে তথ্য রয়েছে হত্যাকারি হুইপপুত্র শারুন এর পেছনে টাকা ঢালছেন। তিনি এসব করিয়ে পার পেতে চাইছেন।
সবুজ বলেন, সাংবাদিক সম্মেলন শেষে প্রেসক্লাবের পুর্ব গেটে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। ওদের একজন আমাকে ফোন করে জানিয়েছে ঘটনার কথা। আমি পুলিশকে অনুরোধ করবো, এসব উপযাচকদের কথায় বিভ্রান্ত হবেন না। আপনারা সুষ্টুভাবে তদন্ত করে যান, প্রকৃত অপরাধি যেনো ছাড়া না পায়।