নিজস্ব প্রতিবেদক
বিদেশে অর্থ পাচার ও পাচারকৃত সম্পদ থেকে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারে কর বিষয়ক অভিজ্ঞ ‘আন্তর্জাতিক কর বিশেষজ্ঞ’ নিয়োগ দিতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) ও আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের জন্য ওই বিশেষজ্ঞ কাজ করবে। এমন অনুরোধ করে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ সই করা চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। শনিবার (১ মার্চ) এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। সংস্থাটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আহরণ ও সকল প্রকার রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন। রাজস্ব আহরণের অংশ হিসেবে গোপনকৃত আয় ও কর ফাঁকি উদঘাটন এবং ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা আয়কর বিভাগের নিয়মিত কাজের একটি অংশ। আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং এ কাজটি তারা সচরাচর সম্পন্ন করে থাকে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট এ দুটি বিশেষায়িত ইউনিট মূলত আয় ও সম্পদ গোপনের কারণে সংঘটিত রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনে কাজ করে ইতোমধ্যে বেশ সফলতা অর্জন করেছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিগত দেড় দশকের বেশি সময়ে দেশের সম্পদের একটি বিশাল অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত এসব সম্পদের উপর কর ধার্য্য করা এবং তা আদায় করার বিষয়ে আয়কর বিভাগের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ নয়। বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ থেকে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) ও আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। একই ধরণের কাজে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন আন্তর্জাতিক কর বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হলে ওই দুটি সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক হবে। যেহেতু উভয় সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তিরা বাংলাদেশি সেহেতু জন্মসূত্রে বাংলাদেশি কোনো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হলে তা বিশেষভাবে সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এদিকে সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ৭ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান সাপেক্ষে বিদেশে থাকা অর্থ বা সম্পদ ফিরিয়ে আনতে ২০২২-২৩ অর্থবছর সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ওই অর্থবছরের ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি নাগরিক এ সুযোগ নেননি। ওই সময় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক আইনি পরামর্শদাতা সংস্থা নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ছাড়াও শেখ হাসিনা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে এনবিআর। যেখানে নাম রয়েছে—শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, ছেলে রেজওয়ান সিদ্দিক ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে ফাহিম, শেখ হেলাল, শেখ তন্ময়, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম।
এছাড়া দেশের বৃহৎ দশটি ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের অধীনে যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত দল গঠন করেছে এনবিআর। ইতোমধ্যে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরাতে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের অধীনে কাজ শুরু করেছে যৌথ টিম। যৌথ দলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), এনবিআরের সিআইসি এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কাজ করছে। দশটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে-এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা, সিকদার ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ।
এস আলম গ্রুপের মালিক এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধ, প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। এস আলমসহ তার সহযোগী ব্যক্তিরা ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর বেক্সিমকো গ্রুপের ১৭টি প্রতিষ্ঠান ১২ বছরে প্রায় ৯৫৭ কোটি টাকা পাচার করেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে ওই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ তিনটি দেশে এই অর্থপাচার করা হয়েছে।