লাখ, লাখ কিংবা হাজার, হাজার নয় মাত্র ১২শ বিনিয়োগকারীর নিয়ন্ত্রণে দেশের পুঁজিবাজারে ভাগ্য। এই বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার সময় পুঁজিবাজারে উত্থান হয়, আবার বিক্রির সময় দরপতন হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাজারের ২৬ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০ জন বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য নির্ধারণ করে মাত্র ১২শ ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।
এই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ন্যূনতম ১০ কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিএসইসির তথ্য মতে, গত একবছরে এই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারীরা প্রথমে বিমা, এরপর মিউচুয়াল ফান্ড, ব্যাংক, ওষুধ ও রসায়ন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পাশাপাশি প্রকৌশল খাতের বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন।
ফলে এই সময়ে পুঁজিবাজারে সূচক বেড়েছে প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট। লেনদেন ৩শ কোটি টাকার কোটা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২ হাজার কোটি টাকার কোটায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায় ফিরছে ব্রোকার হাউজগুলো। আর তাতে পুঁজি হারানো ১৫ লাখ বিনিয়োগকারীর পুঁজি (বাজার মূলধন) ফিরেছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা।
স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিলেন্স বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিগ ভলিয়মের এই বিনিয়োগকারীদের একটি গ্রুপ গতবছরের জুলাই মাস থেকে বেক্সিমকো, বেক্সিমকো ফার্মাসিটিউক্যালস, আইএফআইসি ব্যাংকসহ ১০-১৫টি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। আর তাতে এসব কোম্পানির শেয়ার নূন্যতম দ্বিগুণ থেকে ১০-১২ গুণ দাম বেড়েছে। তারপর তারা বিমা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে।
বিনিয়োগকারী মনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর থেকে বছরের পর বছর ২০ টাকার নিচে পড়ে থাকা বেক্সিমকোর শেয়ার ১০০ টাকা অতিক্রম করেছে। তিনি বলেন, শুধু বেক্সিমকো আর বেক্সিমকো ফার্মাই নয়, ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো, লঙ্কা বাংলা ফাইনেন্স এবং বিমা খাতের কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারে এই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছেন। অর্থাৎ এসব কোম্পানিতে কারসাজি হয়েছে। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এসব কোম্পানির শেয়ার। তাতে পুঁজিবাজার উত্থানের ধারায় ফিরেছে বলে মনে করেন তিনি।
বিএসইসি বলছে, শেয়ার রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হিসাব অনুযায়ী- পুঁজিবাজারে ২৬ মে পর্যন্ত ২৬ লাখ ৫৯ হাজার ৬৩০টি বিও হিসাব রয়েছে।
তার মধ্যে ১৪ লাখ ২৭ হাজার বিও হিসাব সক্রিয় রয়েছে। অর্থাৎ এসব বিও হিসাবে শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১২২৫টি বিওধারী রয়েছেন যাদের পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ রয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। এই বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগই বড় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে।
এই ১২শ বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি পুঁজিবাজারে উত্থান-পতনের অবদান রাখছে ২২ হাজার পোর্টফোলিওধারী বিনিয়োগকারী। যাদের পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ রয়েছে এক কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। যাদের কোটিপতি বিনিয়োগকারী বলা হয়।
এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের অবস্থা এখন অনেক ভালো। ব্যাংক, বিমাসহ বেশিরভাগ কোম্পানি দশ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো ভালো করছে। আগের তুলনায় রিটার্নও দিচ্ছে। তাতে পুঁজিবাজারে বিনিযোগকারীদের আস্থা বাড়ছে। এখন বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগও করছেন।
তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে প্রাণ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। তারা যাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, সেই চেষ্টা চলছে। বেশকিছু বড় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাজারে অংশ নিয়েছেন। তাদের কারণে বাজার দিন দিন চাঙ্গা হচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত।
অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, গত একবছরে পুঁজিবাজার ভালো হয়েছে ঠিক। কিন্তু সব বিনিয়োগকারী লাভবান হয়নি। তার কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার বিক্রি করেছে, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারের দাম আরও বাড়বে বলে লোভে পড়ে কিনেছেন।
তিনি মনে করেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বড় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনা বিক্রির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। দেখতে হবে তারা কী কিনছে, কী বিক্রি করছে। তবেই পুঁজিবাজারে ব্যবসা করতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা।