নিজস্ব প্রতিবেদক,
করোনাভাইরাস অতিমারির প্রভাব মোকাবেলায় শিল্পখাতে দেওয়া সরকারের প্রণোদনার টাকার সিংহভাগ পুঁজিবাজারে চলে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. রকিবুর রহমান। তিনি দাবি করেছেন, প্রণোদনার কোনো টাকা পুঁজিবাজারে আসেনি। রোববার (২৫ জুলাই) রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি এই দাবি করেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, অনেক দিন পর সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশের পুঁজিবাজার যখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের বক্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ও দুঃখজনক। তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন এতে বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত না হন। মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত পুঁজিবাজারে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য না করা, কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া।
রকিবুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান গতিশীলতা প্রণোদনার টাকার কারণে হয়নি। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী উদ্যোগের ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমতে কমতে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তাই ব্যাংকে আমানত রাখা আর লাভজনক নয়। তাই অসংখ্য মানুষ ব্যাংকে মেয়াদী আমানত না রেখে সেই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। অন্যদিকে নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণে এখন চাইলেও নির্দিষ্ট সীমার বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। সেখানে বিনিয়োগের সুযোগ সংকোচিত হয়ে আসায় উদ্বৃত্ত সঞ্চয় পুঁজিবাজারমুখী হয়েছে।
ডিএসইর সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদনে প্রণোদনার টাকা পুঁজিবাজারে এসেছে বলে উল্লেখ করেছে, সেখানে কতগুলো প্রতিষ্ঠানের টাকা এসেছে, কত টাকা এসেছে তার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, বাজারে ১০ কোটি, ২০ কোটি বা ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে, এমন অসংখ্য বিনিয়োগকারীকে চেনেন তিনি। তাদের কেউ প্রণোদনার টাকা পাননি। কারণ এদের কারোরই কোনো শিল্প-কারখানা নেই। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের দাবির ব্যাপারে তিনি ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা এতে সন্দিহান।
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যদি প্রণোদনার কিছু টাকা পুঁজিবাজারে এসেও থাকে, তাহলে তার দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাদের মনিটরিং ফাঁকি দিয়ে পুঁজিবাজারে টাকা স্থানান্তরের কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। যথাসময়ে মনিটরিং না করে এতদিন পর এমন দাবি করার বিষয়টি নিজেদের দায়িত্ব পরিপালনে ব্যর্থতার নামান্তর।
ডিএসইর এই পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানান, যদি কিছু প্রতিষ্ঠান সত্যিই প্রণোদনার টাকার অংশবিশেষ পুঁজিবাজারে নিয়ে এসে থাকে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, যাতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। হার্ড ল্যান্ডিংয়ের পরিবর্তে যেন সফটল্যান্ডিং হয়।
তিনি বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাফিলতি আর উদাসীনতার সুযোগে অনেক ব্যাংক পুঁজিবাজারে সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল। বাজারে যখন বাবল তৈরির আলামত দেখা যাচ্ছিল, তখনই আমরা সবাইকে সতর্ক করেছিলাম। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের টনক নড়েনি। কিন্তু বাবল তৈরি হওয়ার পর হঠাৎ তারা নড়েচড়ে বসে। ব্যাংকগুলোকে মাত্র ৬ মাস সময় দিয়ে তার মধ্যে বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমা নামিয়ে আনতে বলে। বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এত শেয়ার কেনার মত ক্রেতা না থাকায় বাবল বাস্ট করে। বাজারে বিপর্যয় নামে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেকে এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যদি তখন ২ বছর সময় দিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর বিনিয়োগ কমিয়ে আনার ধাপ নির্ধারণ করে দিত তাহলে বাজারে ওই বিপর্যয় নামতো না।
রকিবুর রহমান বলেন, শুধু ২০১০ সালে নয়, এর পরেও বহুবার বাংলাদেশ ব্যাংককে পুঁজিবাজারের স্বার্থ বিরোধী নানা সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। বছরখানেক আগে তারা ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণা করা টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পরে আমাদের দাবির মুখে সেই অবস্থান থেকে তারা সরে আসে।
তিনি বলেন, পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে বোনাস দিতে উৎসাহ যুগিয়ে গেছে। এতে কিছু সুযোগসন্ধানী অসাধু ব্যাংকের উদ্যোক্তা ক্রমাগত বোনাস দিতে দিতে মূলধনের আকার অস্বাভাবিকরকম বাড়িয়ে ফেলেছে। শেয়ার সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় একদিকে শেয়ার প্রতি আয় ডাইলুটেড হয়ে অনেক কমে গেছে, অন্যদিকে বাজার এই শেয়ারে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় এর দাম আর বাড়ে না।
তিনি আরও বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ব্যাংকের মালিক এর শেয়ারহোল্ডাররা। তাই ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ দেবে না বোনাস দেবে, মূলধনের আকার কী হবে তা শেয়ারহোল্ডারাই নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অধিকার নেই এখানে হস্তক্ষেপ করার।
ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, জাতিরজনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শিল্প-উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে নয়, শিল্পকারখানার জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থ পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করবে। আর এটি করার জন্য একটি স্থিতিশীল ও গতিময় পুঁজিবাজার দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে মনে হয়, তারা চায় না পুঁজিবাজার স্থিতিশীল, গতিময় ও বিকশিত হোক। যতই খেলাপি ঋণ বাড়ুক, তবু প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে না এসে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিক এটিই বোধ হয় চায় তারা। কিন্তু এই চাওয়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বরখেলাপ, দেশ ও অর্থনীতির স্বার্থের পরিপন্থী এটি মনে রাখতে হবে।
বিএসডি/এমএম