নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা থেকে বেআইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে পাঠানো একটি ফরোয়ার্ডিং ঘিরে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এজাহারভুক্ত আসামি ও ছাত্রলীগ নেতা মো. এনামুল হক এনামকে (৩২) আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো ছাড়াই। অথচ তিনি থানায় বিস্ফোরক ও দণ্ডবিধি আইনে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
তবে একই মামলার আরেক আসামি জহির আহমদকে (৪২) একই দিন যথাযথ প্রক্রিয়ায় ফরোয়ার্ডিং দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আদালত মামলা ছাড়া সোপর্দ করা আসামি এনামুলকে সঙ্গে সঙ্গে জামিন দিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া আরেক আসামি জহিরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক লেনদেন করায় আসামি এনামুলকে বেআইনি প্রক্রিয়ায় চালান দেওয়া হয়েছে। আর অনৈতিক লেনদেন না করায় আসামি জহিরকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। যদিও বেআইনি প্রক্রিয়ায় চালানের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতকানিয়া থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে এমনটি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ (আংশিক সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) আসনে নির্বাচন করেছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) অলি আহমদ। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী সাইক্লোন সেন্টার এলাকায় ছাতা প্রতীকের পক্ষে কর্নেল অলির ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক সানির নেতৃত্বে নির্বাচন প্রচারণা চলছিল। এ সময় আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এলডিপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। এরপর আহত ভুক্তভোগী ও কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা সরওয়ার জামাল বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় মামলাটি করেন। গত বছরের ২০ আগস্ট মামলাটি থানায় রেকর্ড করা হয়। এতে ৩৪ নম্বর আসামি করা হয় কেঁওচিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কেঁওচিয়া আহমদ হোসেন সিকদার ছেলে মো. এনামুল হক এনামকে এবং ৩৬ নম্বর আসামি করা হয় একই ইউনিয়নের মাইজ পাড়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে জহির আহমদকে (৪২)।
গত শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে কেঁওচিয়া ২ নম্বর ব্রিজ এলাকা থেকে আসামি এনামকে গ্রেপ্তার করে সাতকানিয়া থানা পুলিশ। পরদিন (রোববার) কেঁওচিয়া ইউনিয়নের কেরানিহাট বাজার থেকে জহির আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারের পর থেকে দুজনের বিষয়ে সাতকানিয়া থানায় দেনদরবার চলে। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় আসামি এনামকে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো ছাড়াই ফৌজদারি কার্যবিধি ১৫১ ধারায় আদালতে পাঠানো হবে। যেন তার সঙ্গে সঙ্গে জামিন হয়ে যায়। আরেক আসামি জহিরকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি দুজনকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার ইকবালের আদালতে প্রেরণ করা হয়। এদিন জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আসামি এনামকে সঙ্গে সঙ্গে জামিন দেওয়া হয়। এ ছাড়া জহিরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে ১৫১ ধারায় আদালতে সোপর্দের সুযোগ নেই। তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে হবে। কোনো মামলা না থাকলে ১৫১ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়, এটিই নিয়ম।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো পুলিশ অফিসার ‘আমলযোগ্য অপরাধ হবে’ এমন ষড়যন্ত্রের খবর পান অথবা তার নিকট প্রতীয়মান হয় যে, এই অপরাধ সংঘটন অন্যভাবে নিবারণ করা যাবে না, তা হলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ও ওয়ারেন্ট ছাড়াই ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করতে পারেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খাঁন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এজাহারভুক্ত যে কাউকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। এর বাইরে ভিন্ন কোনও নিয়ম নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারায় আদালতে তাদের সোপর্দ করা হয়, যাদের নামে কোনো মামলা নেই। সাতকানিয়া থানার বিষয়টি শুনে মনে হয়েছে, আসামিকে জামিন পাইয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে। এর মানে হলো আসামিকে এক প্রকার বেআইনি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফৌজদারি মামলা বা অভিযোগে একজন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়া মাত্র পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রথম কাজ তার নাম-ঠিকানা যাচাই করা। এরপর সেই তথ্য দিয়ে সিডিএমএস (ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) ওয়েবসাইটে সার্চ দেওয়া। যেখানে আসামিদের মামলা ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জমা থাকে। আসামি এনামুলের ক্ষেত্রে সাতকানিয়া থানার দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সিডিএমএস যাচাই করলেই এনামুলের মামলাটি পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই আসামি এনামুলের ফরোয়ার্ডিংয়ে মামলার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার ছিল।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নতুন যোগ দিয়েছি। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে জানতে পারেন।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাতকানিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আ. মুন্নাফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে এমনটি করা হয়েছে। অনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রকম হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম সানতু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। তবে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা উচিত হবে না।