প্রায় তিন বছর ধরে গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা না দেওয়া, ইন্টারনেট প্যাকেজের নামে প্রতারণা ও গ্রাহকের অজান্তে টাকা কেটে নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে পারত গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে ২০১৭ সালে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটার এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এ বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। শুনানিসহ আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পরে আর অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বর্তমানে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে একেবারেই ‘নিশ্চুপ’ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেও নারাজ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালক বাবলু কুমার সাহা।
গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তবে ২০১৭ সালে মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা হাইকোর্টে রিট দায়ের করলে উচ্চ আদালত এ বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। এরপর থেকে থমকে আছে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে কার্যক্রম। তখন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর। তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, আইনি জটিলতা দূর হলে অপারেটরদের বিরুদ্ধে আবারও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লস্করের স্থলাভিষিক্ত হন বাবলু কুমার সাহা। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে তিনি কোনো কথাই বলতে চান না।
কয়েক সপ্তাহ ধরে মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কল দিলেও রিসিভ করেননি অধিদফতরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয়ে একাধিকবার এসএমএস দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
হাইকোর্টে রবি অজিয়াটার দায়ের করা রিট নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। তারা বলছেন, অধিদফতর গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণে আন্তরিক হলে আইনি প্রক্রিয়ায় সামনে যেতে পারত। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের বিষয়টি সুরাহা করতে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সেখানে শুনানি হলে গ্রাহকের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ ছিল।
আইনজীবীরাও বলছেন, কোনো রিট আদেশে আদালত স্থগিতাদেশ দিলে সেটিই চূড়ান্ত কিছু নয়। আইনি প্রক্রিয়ায় সামনে যাওয়ার সুযোগ এখনো আছে অধিদফতরের জন্য। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার অনিক আর হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের এখন শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’ কিন্তু সেই উদ্যোগই নিচ্ছে না জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। শুধু তাই নয়, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে রিট পরবর্তী কোনো আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়েও মন্তব্য করতে নারাজ মহাপরিচালক বাবুল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের পক্ষে একটি বিধিমালা প্রণয়ণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (ক্যাব) বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ক্যাব-ও সেভাবে এগিয়ে আসতে পারেনি। পরবর্তী শুনানির বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি জানাতে পারেনি তারাও।
মন্তব্য জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, হাইকোর্টে রিট হওয়ার আগে আমাদের এখানে মাসে ১৫ থেকে ৩০টি অভিযোগ আসত। আমরা এখন কোনো সমাধান দিতে না পারায় আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসছে না।
তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে রিট হওয়ার পর আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু রিটের আর নিষ্পত্তি হয়নি। এখনো স্থগিতাদেশ বহাল রয়েছে। অপারেটররা মামলা করেলও ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর আর বেশিদূর এগোয়নি। ইচ্ছে করলে তারা এগুতে পারত। তা না করায় এখন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যেহেতু বর্তমান মহাপরিচালকের আমলে রিট হয়নি, তিনিও বেশি সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন না। ইচ্ছা করলে বিষয়টিকে এগিয়ে নেওয়া যেত।’
এদিকে, মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহক অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ সুরাহায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একটি কল সেন্টার (১০০) রয়েছে। এছাড়া লিখিতভাবে অভিযোগ জানানোরও সুযোগ আছে। তবে গ্রাহকের সমস্যা সমাধানে বিটিআরসি অনেকটাই উদাসীন বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। বিটিআরসিও স্বীকার করছে, সিম বার, নেটওয়ার্ক বিস্তৃতকরণ ও অপারেটরের নিজস্ব প্ল্যানিং নির্ভর বিষয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হয়।
বিটিআরসির দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বিভিন্ন বিষয়ে অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৮৩টি। এর মধ্যে সমাধান হয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৮টি অভিযোগ। অভিযোগ নিষ্পত্তির শতকরা হার ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ১ হাজার ১১৫টি অভিযোগের নিষ্পত্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বিটিআরসি বলছে, ওই সময়ে প্রাপ্ত কলের মধ্যে বেশিরভাগ কল সাধারণ জিজ্ঞাসা ও তথ্য প্রদান নির্ভর। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ২ লাখ ৩০ হাজার ৫২৬টি। এর মধ্যে সমাধান হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৯টি। সমাধানের শতকরা হার ৯৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এ বছর এখনো নিষ্পত্তি না হওয়া অভিযোগের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৭৭টি। সমাধান প্রক্রিয়াধীন থাকা অভিযোগের শতকরা হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিটিআরসি বলছে, অপারেটরদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ নেই। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করে গুণগত সেবা প্রদান এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন, বিধি, নীতিমালা অনুসারে অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণ করা বিটিআরসির কাজ। বিটিআরসি সফলতার সঙ্গে এ কাজটি করে আসছে। গ্রাহককে তাদের প্রাথমিক অভিযোগ, অসন্তোষ সংশ্লিষ্ট অপারেটরদের হেল্পলাইনে অবহিত করতে হয় । তারা যদি নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে সুরাহা না করে সেক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণসহ বিটিআরসির কলসেন্টারে (১০০) এবং লিখিত আকারে প্রাপ্ত অভিযোগ বিটিআরসি থেকে সমাধান করা হয়ে থাকে। তবে সিম বার, তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য, নেটওয়ার্ক বিস্তৃতকরণ ও অপারেটরের নিজস্ব প্ল্যানিং নির্ভর বিষয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ হয়।
জানতে চাইলে মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ অনুযায়ী কোনো গ্রাহক যদি অভিযোগ করেন, তা সাত দিনের মধ্যে কমিশন নিষ্পত্তি করবে— এমন আইন রয়েছে। আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় সে ক্ষেত্রে কমিশন ওই অপারেটরকে ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, কমিশনে গ্রাহকের অনেক অভিযোগ জমা পড়ে রয়েছে। এমনকি গণশুনানিতে সাধারণ গ্রাহকরা অনেক অভিযোগ করে থাকেন, কিন্তু এর কোনো প্রতিকার লক্ষ করা যায় না।
তিনি আরও বলেন, ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার আইন ২০০৯ অনুযায়ীও সেবা খাতের মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু আইনের ব্যাপ্তি না থাকার কারণে গ্রাহকরা ১৬ হাজার অভিযোগ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে জমা দিলেও এর সুরাহা হচ্ছে না। কারণ ওই ২০১৭ সালের রিট। এরপর থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর আর টেলিযোগাযোগ গ্রাহকদের অভিযোগ আর নিষ্পত্তি করছে না। বিটিআরসিও গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। এতে গ্রাহকরা মোবাইল অপারেটরদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে।’