নিজস্ব প্রতিবেদক,
বাগেরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে দরিদ্র শিশুদের মুখে প্রতিদিন খাবার তুলে দিচ্ছে কৃষকের রান্নাঘর। করোনাকালীন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র পরিবারের ৫০ জন শিশুর দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি।
বাগেরহাট সদর উপজেলার পিসি ডেমা গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা খালেদা বেগম। করোনাকালীন সময়ে ঘরের বারান্দায় সুই-সুতা নিয়ে কাঁথা সেলাই করছিলেন। তারই দুই নাতনি প্রতিদিন দুপুরে পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছেন কৃষক সমিতির নেতা শেখ তানজিমের বাড়িতে। মহামারির এই সময়ে প্রতিদিন দুপুরে মানসম্মত সুষম খাবার খেতে পারায় খুশি তিনি। শুধু খালেদা বেগম নয়, এই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অর্ধশত শিশু প্রতিদিন দুপুরে খাবার খেতে পেরে খুশি।
কৃষক শেখ তানজিমের বাড়িতে সকাল থেকে পাঁচজন নারী স্বেচ্ছাশ্রমে রান্নাবান্নার কাজ করেন। দুপুর ২টা বাজার সাথে সাথে শিশুদের খাবার পরিবেশন করা হয়। কখনো পোলাও, কখনো খিচুড়ি, কখনো সাদা ভাতের সাথে ডিম, সবজি, ডাল, মাছ, মাংস থাকে খাদ্য তালিকায়। এ কাজে সহযোগিতা করতে পেরে খুশি নারীরা।
রোববার (১৫ আগস্ট ) কার্যক্রমের ৫০তম দিনে সরেজমিনে কৃষক শেখ তানজিমের বাড়িতে দেখা যায়, ৫৫ জন শিশুর সাথে দুইজন বৃদ্ধ খাবার খাচ্ছিলেন আনন্দমুখর পরিবেশে। খাদ্য তালিকায় কখনো পোলাও, কখনো খিচুড়ি, কখনো বা সাদা ভাত। সাথে থাকে ডিম, সবজি, ডাল, মাছ, মাংস থাকে। কৃষকের রান্নাঘরে খাবার খেতে আসা আলিফ নামের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, বাড়িতে এত ভালো খাবার খেতে পারি না। এখানে সবাই মিলে একসঙ্গে খাবার খাই। খুব ভালো লাগে।
ভ্যানচালক হাফিজুর রহমানের ছেলে রবিউল বলেন, করোনার মধ্যে একদিন এই বাড়ির কাকা আমারে ডাইকে নিয়ে আইসে দুপুরের খাবার দেয়। এরপর থেকে দুপুর হলেই আমি প্রতিদিন এখানে চলে আসি। মজা করে খাবার খাই। শুধু রবিউলই নয়, অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এই কৃষকের রান্নাঘরে এসে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে।
প্রতিবেশী শাজাহান আলী বলেন, আমাদের গ্রামে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সব এলাকাতে যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে কোনো শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে না। আমি চাই এই কার্যক্রম যেন সামনের দিনেও চলমান থাকে।
সেচ্ছায় রান্নার কাজে নিয়োজিত শেফালি বেগম বলেন, করোনার এ সময়ে গ্রামের অনেক অসহায় পরিবার বিপাকে রয়েছে। অনেক পরিবারের শিশুরা রয়েছে অভুক্ত। তাদের দেখলে আমার খারাপ লাগে। তাই কষ্ট হলেও প্রতিদিন পঞ্চাশ থেকে ষাট জনের খাবার রান্না করি। তারা যখন পেট ভরে খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দেয়। আমার সব কষ্ট পানি হয়ে যায়। রান্নার কাজে আরও ৫ জন প্রতিবেশী স্বেচ্ছায় সাহায্য করে বলে জানান তিনি।
উদ্যোক্তা কৃষক শেখ তানজিম তানজু বলেন, করোনাকালীন সময়ে আমাদের গ্রামের কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে চলে তাদের জীবনযাপন। এই অবস্থায় কৃষকদের সন্তানদের একবেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের উদ্যোগের কথা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরে অস্ট্রেলিয়ান প্রবাসী ফজলুল বারীর সংগঠন অমর্ত্য ফাউন্ডেশন আমাদের পাশে দাঁড়ায়। গত ২৪ জুন থেকে গ্রামের অসহায় পরিবারের ৫০ জন শিশুকে নিয়ে দুপুরের খাবারের আয়োজন করি। প্রতিদিন খাবারে আমাদের দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসী ও বিত্তবানদের সহায়তায় এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
ডেমা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির সভাপতি শেখ আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষকদের দুঃখ দুর্দশার শেষ নেই। তাদের নেই কোনো কথা বলার জায়গা। আমরা গ্রামের কৃষকরা উদ্যোগ নিয়ে এই সংগঠন গড়ে তুলি। করোনাকালীন সময়ে কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে বাচ্চাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করি। শুধু খাবার দিয়েই নয়, আমরা শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
বাগেরহাট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন বলেন, অমর্ত্য ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও ডেমা ইউনিয়ন কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির আয়োজনে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের এই কর্মকান্ডকে স্বাগত জানাই। এ ধরনের কার্যক্রমে আরও অনেক মানুষ এগিয়ে আসবে বলে আশা করছি।
বিএসডি/আইপি