নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফেব্রুয়ারির বইমেলা মার্চ পর্যন্ত গড়ালে কিছুটা ছন্দপতন হয়। করোনাকালের গত বছরের বইমেলার অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে। এবারও প্রকাশকদের কেউ কেউ তেমন আশঙ্কাই করছিলেন। কিন্তু পহেলা মার্চের আগের দিন অন্তত তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বইমেলায় এখনো উৎসবের আমেজ।
ছন্দপতনহীন জমজমাট মেলায় পাঠকের আনাগোনা আছে বেশ। বই বিক্রিও চলছে সমানতালে। ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে বইমেলার সামনের দিনগুলোও বেশ ভালো কাটবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সবাই।
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি যুগান্তরকে বলেন, সত্যিকার অর্থে মার্চ মাসের মেলা নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকে। গত বছরের মেলায়ও এমনটা হয়েছে। তবে আমরা এবার দেখছি মানুষ এখনো দলে দলে আসছে। প্রিয়জনের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে মেলায় ঘুরে ঘুরে বই কিনছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ বা ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা ছাড়া মেলার আর কোনো বড় ধরনের ঝুঁকি নেই।
এদিন মেলায় প্রথমার প্যাভিলিয়নে ছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তিনি অনেকটা সময় মেলায় অবস্থান করে পাঠকদের হাতে অটোগ্রাফসহ বই তুলে দেন।
সোমবার মেলার দ্বার খুলে যায় বেলা ৩টায় চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। শুরু থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে পাঠক ক্রেতাদের সমাগম শুরু হয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে হতেই অন্যান্য দিনের মতোই জমে যায় মেলা। এদিনও হাতে হাতে ছিল বই। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেককে এসে বই কিনতে দেখা যায়।
মঞ্চের আয়োজন : বিকালে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গোলাম মুস্তাফা এবং এম আবদুল আলীম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সারওয়ার আলী এবং সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন মুনতাসীর মামুন।
প্রবন্ধ উপস্থাপন করে গোলাম মুস্তাফা বলেন, আনিসুজ্জামানের গবেষণা শুধু বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় সীমিত নয়, এগুলোর সামাজিক উপযোগিতা ও গুরুত্বও অনস্বীকার্য। আমাদের জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রে যেসব দ্বন্দ্ব নানা সময়ে প্রকট হয়েছে, তিনি সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সেই দ্বন্দ্বগুলোর যুক্তিসঙ্গত মীমাংসায় উপনীত হওয়াকে তার কর্তব্য বলে মনে করেছেন। এ কারণেই তার পাণ্ডিত্য ও গবেষণা বিদ্যায়তনিক সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের পাথেয় হয়ে উঠেছে। ‘
স্মরণ : রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এম আবদুল আলীম বলেন, ভাষাসংগ্রামী-নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম এবং ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে উজ্জ্বল দুটি নাম। আপন কর্ম-সাধনায় তারা কীর্তিমান হয়েছেন। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির পঠন-পাঠন, গবেষণা এবং উৎকর্ষ সাধনে তারা যে অবদান রেখে গেছেন, তা অতি গৌরবের।
আলোচকবৃন্দ বলেন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম এবং শামসুজ্জামান খান- এই তিন মহিরুহ তাদের চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড দ্বারা আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার অধিকারী এই তিন মনীষী বাঙালি জাতিসত্তাকে অন্তরে ধারণ করেছিলেন। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অগ্রযাত্রায় তাদের চিন্তাচেতনা ও দর্শন আমাদের পথ দেখাবে।
সভাপতির বক্তব্যে মুনতাসীর মামুন বলেন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম ও শামসুজ্জামান খান-তিনজনই সারাজীবন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিবেদিত ছিলেন। তবু সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছিন্ন। ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়াই ছিল তাদের জীবনের আদর্শ, সংগ্রাম ও স্বপ্ন। সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই তিন কীর্তিমান বাঙালিকে আমাদের স্মরণ করতে হবে। এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন হরিশংকর জলদাস এবং মোহিত কামাল।
অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি বদরুল হায়দার, হাসনাইন সাজ্জাদী এবং হানিফ খান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আহসানউল্লাহ তমাল, সাফিয়া খন্দকার রেখা, ডা. আওরঙ্গজেব আরু এবং মিজানুর রহমান সজল। সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল ফরিদা ফারভীনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অচিন পাখি’ এবং মো. সাইফুল ইসলামের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘উজান’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আবু বকর সিদ্দিক, আজগর আলীম, আলম দেওয়ান, রাজিয়া সুলতানা, সমীর বাউল, শান্তা সরকার, সুধীর মন্ডল।
নতুন বই : সোমবার বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৯৩টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে-কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে মুহম্মদ নূরুল হুদার ছোটগল্প ‘আয়না দিঘি’ ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘জাতীয়তাবাদের উদ্বিগ্ন হৃদয়’, আগন্তুক থেকে এসেছে নাসরীন রেখা ও অসীম সাহার সম্পাদনায় গল্পগ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের দুই কিশোরী’, চিরদিন প্রকাশনী থেকে এসেছে ডা. কাজী খাদেমুল ইসলামের আত্মজীবনীমূলক বই ‘আশার জীবনকথা’, ক্যারিয়ার পাবলিকেশন থেকে এসেছে অ্যাডভোটেক মো. আজমত উল্লাহ খানের বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ : আদর্শ ব্যক্তি ও জাতি গঠনে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত’, পারিজাত প্রকাশনী থেকে এসেছে মোনায়েম সরকারের প্রবন্ধ ‘মুজিবনগর সরকারের সংকট ও সাফল্য’, অনন্যা থেকে এসেছে গোলাম মাওলা রনির প্রবন্ধ ‘একটি রাম ছাগলের আত্মকথা’, মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ‘একাত্তরের বন্ধু যারা’, বিদ্যাপ্রকাশ থেকে এসেছে তাজুল মোহাম্মদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ‘ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ : অগ্রণী ভূমিকায় সিলেট’ ও রুমা মোদকের নাটকবিষয়ক বই ‘নির্বাচিত নাটক’, অন্বয় প্রকাশ থেকে এসেছে অধ্যাপক অপু উকিলের সম্পাদনায় সংকলনগ্রন্থ ‘শেখ রাসেল আমাদের ভালোবাসা’, বাউন্ডুলে থেকে এসেছে আসাদ চৌধুরীর জীবনী ‘আবুল হাশিম’।
বিএসডি/ এফএস