নিজস্ব প্রতিবেদক
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাক। একই সঙ্গে জিয়াউর রহমান এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান সুবিধাভোগী। সদ্য স্বাধীন ও নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অকার্যকর ও ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদেশি কিছু শক্তির যোগসাজশে জিয়ার অনুগত সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য এবং অন্যান্য পেশার কয়েকজন এ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দিন থেকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো দেখলে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এ হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাভোগী কারাl
‘সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাভোগী কারা?’– এ শিরোনামে রোববার (২৯ আগস্ট) রাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটি আয়োজিত ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন আলোচকরা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য সচিব এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। প্রধান আলোচক ছিলেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
আলোচক ছিলেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার, সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।
স্বাগত বক্তব্যে ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ইতিহাসের একটা দাবি থাকে, প্রায়োরিটির বিষয় থাকে। জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের প্রচলিত আইনে খুনিদের বিচার হয়েছে l আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেককেই বিচারের আওতায় আনা যায়নিl তবে আজ ইতিহাসের দাবি অনুযায়ী সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী কারা, মূল বেনিফিশিয়ারি কারা -এই বিষয়গুলো উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন l ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ওই ব্যক্তিগুলো কে।
প্রধান আলোচক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের আগে মেজর জিয়া বলে কাউকে বাংলাদেশের কেউ চিনতো না। জিয়াউর রহমান যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, তার প্রমাণ হলো, তার দল দ্বারা ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানানো। খুনি জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য বন্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে এ বিচারকার্য শুরু করেন।
এ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম প্রতিটি পদে পদে কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল সেই বর্ণনা দিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, বিএনপি সরকার খুনিদের আশ্বস্ত করেছিল, আমরা যদি আবারও ক্ষমতায় আসতে পারি, তাহলে এ মামলা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেব, তোমাদের কিছু হবে না। শেখ হাসিনা যদি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় না আসতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হতো না।
বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, খুনি জিয়াউর রহমান পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ‘প্রবলেম অব ডেভেলপমেন্ট’ বইটি আমি পড়ি, সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে মেজর জিয়ার সরাসরি যোগসূত্র ছিল। খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে, তিনি একটি বিবৃতি দিয়েছিল। যেখানে তিনি একাধিকবার বলেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চাবিকাঠি নেড়েছিল জিয়াউর রহমান।
নানা তথ্য, উপাত্ত এবং সাক্ষীর কথা উল্লেখ করে সামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, খুনি জিয়া এ হত্যাকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলার মাটিতে ফিরে এলেন, আমার মনে হয় তখন থেকেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছে, এরা বাংলাদেশের গৌরবগাঁথা, গৌরব ইতিহাস মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে আমরা জয়লাভ করেছি, বিজয় অর্জন করেছি, স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই প্রভুরা এটা মেনে নিতে পারেনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড একদিন, দুদিন, ছয়মাস, নয় মাসের পরিকল্পনা ছিল না, এটা ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনা, এর রয়েছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট।
যারা জাতির পিতাকে হত্যার সুবিধাভোগী হিসেবে, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে, সরাসরি হত্যাকারী হিসেবে; জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে, যে রাজনীতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একেবারে বিপরীত, সেই রাজনীতি কী করে বাংলাদেশে থাকে?
সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত বলেন, ৭৫ এর পর দেশে একটি শ্বাসরুদ্ধর পরিস্থিতি ছিল। ক্ষমতার প্রতি জিয়াউর রহমানের প্রচণ্ড লোভ ছিল। রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে, জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে এনেছিল। আর খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণ আদালতের রায়কে অস্বীকার এবং বিচার বিভাগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিল।
ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ এবং জাতির পিতার লালন করা, সোনার বাংলার স্বপ্নকে হত্যা করা। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পরাজিত হয়েছিল। এই পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই, সিআইএ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মূলত দেশীয়, আন্তর্জাতিক এবং সুবিধাভোগীদের সমন্বিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়।
সভাপতির বক্তব্যে ড. মশিউর রহমান বলেন, শুধু কয়েকজন বিপথগামী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, এটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয়। বাংলাদেশের চেতনাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য একটা বিরাট ষড়যন্ত্র এবং বড় শক্তির প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। বিভিন্ন ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ থেকে আমরা সেই বড় শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। জিয়াউর রহমানের কথা শুনে কেউ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। তার কথার সেই ক্রেডিবেলিটি ছিল না, সব ঘটনাই ঐতিহাসিক নয় কিংবা ঐতিহাসিকের মর্যাদা পায় না। সেই ঘটনাই ঐতিহাসিক মর্যাদা পায় যা ওই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কথার ক্রেডিবেলিটি ছিল, এটা তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জন করেছেন, তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন, তিনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি, তার চরিত্রের নানা গুণাবলী, ত্যাগ এবং লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় একটা কথা বলতেন, জনগণের আস্থা ছাড়া রাজনীতি করা সম্ভব নয়।
আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য শবনম আজিম।
বিএসডি/এমএম