নিজস্ব প্রতিনিধি:
মার্কিন লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী হেলেন কেলার বলেছেন, ‘একটি বই ১০০টি বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান।’ ‘প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়’, বলেছেন দার্শনিক এরিস্টটল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনই একটি বিশেষ জাতের মানুষ।’
এমন সব অমর বাণীর মতো সত্য বন্ধুত্বের নিদর্শন ছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুনবতী চাপাচৌ গ্রামের আমীর হোসেন ও সুধীর বাবু। কিন্তু হঠাৎ সুধীর বাবুর মনের আকাশে বিষাদের ঘনঘটা। কিছুতেই কাটছে না মনের নিষণ্নতা।
এ সময় নামাজের পেছনে এক কোণে গাছের গুঁড়িতে বসে কাঁদছিলেন সুধীর বাবু। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দুধর্মের হয়েও মুসলমান বন্ধুর বিদায়লগ্নেও সঙ্গে থাকায় দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন।
সরেজমিন শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুনবতী চাপাচৌ গ্রামে গিয়ে সুধীর বাবুর বাড়িতে গেলে দেখা যায়, দীর্ঘদিনের বন্ধুকে হারিয়ে সুধীর বাবু বাকরুদ্ধ। ছোটবেলার বন্ধুর মৃত্যুতে এখনো কাঁদছেন সুধীর। মনের মধ্যে অটুট থাকা বন্ধুর সঙ্গে কাটানো সব স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাই গত চার দিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না তিনি। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করতে পারছেন না।
গুণবতী বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমীর হোসেন ও সুধীর বাবুর বন্ধুত্ব অনেক দিনের পুরোনো। তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা ছিল দৃষ্টান্ত। দুজনই সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। এ ছাড়া এলাকার যেকোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য সবার আগে ছুটে যেতেন তারা দুজন।
স্থানীয় বাজারে মুদি দোকান ছিল আমীর হোসেনের। এ ছাড়া গুণবতী মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন আমীর হোসেন। সেই মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর এবং এলাকার সব মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে এলাকাবাসী। অন্যদিকে সুধীর বাবু বাড়ির মন্দিরে আমিরের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করেন।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালের দিকে গুণবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে পড়াশোনা শুরু করেন আমীর হোসেন ও সুধীর বাবু। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় দুজনের পরিচয় হয়। আমীর হোসের নিষ্ঠাবান হওয়ায় বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন সুধীর বাবু। এদিকে অর্থসংকটে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন সুধীর। কিন্তু একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার পরও সেই বন্ধুত্ব টিকে যায় ৪৫ বছর।
৪০ বছর আগে দুজনে একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। ব্যবসায়িক কাজে ঘুরেছেন বিভিন্ন জেলায়। এক দিনের জন্যও তাদের ঝগড়াবিবাদ কিংবা মনোমালিন্য হয়নি। আট বছর আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সুধীর বাবু। তখন ব্যবসা ছেড়ে দেন। স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকান ছিল আমীর হোসেনের। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়েও বন্ধুর দোকানে চলে যেতেন সুধীর।
আমীর হোসেনও স্বাভাবিক ও সুস্থ ছিলেন। কিছুদিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন দিন পর না-ফেরার দেশে চলে যান আমীর। বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুর খবর কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি সুধীর বাবু। তাই আমীরের মরদেহ বাড়িতে আনার পর ছুটে যান সুধীর বাবু। তাকে কবর দেওয়া পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন আর কেঁদেছিলেন।
দুজনের বন্ধুত্বে যারা সাক্ষী, তাদের একজন আমীর হোসেন দোকানের পাশের ব্যবসায়ী মিতালী ট্রেডাসের মো. ইব্রাহীম। তিনি জানান, তারা দিনের বেশির ভাগ সময়ই একসঙ্গে কাটাতেন। সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। এমন বন্ধুত্বে নিদর্শন খুব কম দেখা যায়। এ কারণে বাজারের সব ব্যবসায়ী তাদের এক নামে চেনেন।
ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান জানান, ছোটবেলার বন্ধু তারা। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছেন। ফলে তাদের বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হয়। একজনের বিপদে আরেকজন পাশে থাকতেন। আমির ভাই মারা যাওয়ার পর সুধীর বাবু অনেক কেঁদেছেন। তারা এতটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন যে দুজন হিন্দু-মুসলিম, সেটা বোঝা যেত না।
আমীর হোসেনের বড় ছেলে কাজী দোলেয়ার হোসেন সুমন জানান, সুধীর চাচা হিন্দু, আমরা মুসলমান। কিন্তু জানাজার সময় পেছনে বসে কান্নার দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়েছি। তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে বলার কোনো ভাষা নেই। তাদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আমার বাবা নেই। এখন সুধীর চাচাও অসুস্থ। আমরাও তার খোঁজখবর রাখছি। বাবার বন্ধুর জন্য ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সব সময় সঙ্গে থাকব।
কথা হয় সুধীর বাবুর সঙ্গে। বন্ধুর জন্য আবেগ আর কান্না দিয়ে বলেন, বন্ধু আমীর হোসেনের আগে যদি আমি মারা যেতাম, আমার জন্য সে কান্না করত। আহারে, আমার বন্ধু চলে গেছে, আমি থেকে গেছি। বন্ধুর বিদায়লগ্নে কিছু করতে পারিনি। আমরা ৪৫ বছর একসঙ্গে ব্যবসা করেছি। সে অনেক সৎ ছিল।
তিনি বলেন, আমি হিন্দু, সে মুসলমান, এসব নিয়ে সে কোনো কিছু ভাবত না। ভাই সমতুল্য ইজ্জত দিত। এ জন্য তাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। বন্ধুর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আমি আর স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে গেছি।
বর্তমান প্রজন্মের বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুধীর বাবু। তিনি বলেন, বর্তমানে যুগে স্বার্থের জন্য বন্ধু বন্ধুকে খুন করে। এখন আর আগের মতো আন্তরিক বন্ধুত্ব নাই। সবাইকে আন্তিরক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এ সময় বন্ধু আমীরের আত্মার শান্তি কামনায় সবার দোয়া চেয়েছেন সুধীর বাবু।
সুধীর বাবুর শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে বলেন, গুণবতী কালীমন্দির সংস্কারের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। আমরা হিন্দু-মুসলিম একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠার পালন করি। কেউ কখনো বাধা দেয়নি। বর্তমান এমপি সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন মন্দিরটি ঠিক করে দেবেন। কিন্তু এখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমার মৃত্যুর আগে যেন এই মন্দিরটি সংস্কার করে দেবেন। আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে পূজা ও কৃষ্ণনাম করতে চাই।
বিএসডি/আইপি