নিজস্ব প্রতিবেদক
বরগুনায় সুপেয় পানির সংকট মেটাতে মানুষের ঘরে ঘরে জমানো পানিই এখন হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র। ড্রাম, বালতি, ট্যাংক- যেখানেই পানি জমে আছে, সেখানেই বাসা বেঁধেছে এডিস। সর্বশেষ জরিপ বলছে, জেলার সদর উপজেলায় এডিস মশার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে ৮ গুণ বেশি। বরগুনা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা আরও ভয়াবহ- ব্রুটো ইনডেক্স ১৫৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, উৎস বন্ধ না করলে ডেঙ্গু ঠেকানো সম্ভব নয়।
বুধবার (২৫ জুন) বিকেলে বরগুনার ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আইইডিসিআরের জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের জরিপ অনুযায়ী, যেখানে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ শতাংশ হওয়া উচিত, সেখানে বরগুনা সদরে তা দাঁড়িয়েছে ১৬৩.০৪ শতাংশে। আর বরগুনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে এই সূচকের গড় ৪৭.১০ শতাংশ- যার মধ্যে ৭ নম্বর ওয়ার্ড এককভাবে ১৫৩.৩৩ শতাংশ নিয়ে ‘হাই রিস্ক জোন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এই ভয়াবহ চিত্রটি উঠে এসেছে ১৬ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত আইইডিসিআরের পরিচালিত এক জরিপে, যেখানে বরগুনা শহর ও সদর উপজেলার ১৮৪টি বাড়ি ঘুরে দেখা হয়। এর মধ্যে পৌর এলাকায় ১৩৮টি এবং গ্রামীণ এলাকায় ৪৬টি বাড়ি ছিল।
জরিপে দেখা গেছে, যেসব বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ৩৮.৪৬ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রাম এবং ২৭.৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বালতি ছিল মূল ‘ব্রীডিং সোর্স’। এগুলো মূলত জমানো পানির জন্য ব্যবহৃত হয়।
এই প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রত্না দাস বলেন, অনেকেই পানি ঢাকনা দিয়ে রাখেন না। কেউ পাতলা কাপড় ব্যবহার করেন। পুরোনো পানি না ফেলে তার ওপরই আবার পানি জমা করা হয়, এতে লার্ভা তৈরি হচ্ছে।
রত্না দাস আরও বলেন, গতবারও বরগুনায় ডেঙ্গু ছিল, তবে এবার ঈদের সময় মানুষের আসা-যাওয়া বেশি হয়েছে। বাসা ফাঁকা রেখে পানি খালি না করাও বড় কারণ।
আইইডিসিআরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বরগুনায় ডেঙ্গুর সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ডেন ৩ (৪৬.৫ শতাংশ)। এরপর ডেন ২ (৩৯.৫ শতাংশ) এবং ডেন ২+৩ মিশ্র সংক্রমণ রয়েছে ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে।
সংস্থার পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, চিত্রটা কতটা ভয়াবহ আমরা এখনো পুরোপুরি বলতে পারছি না। তবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে, যদিও মৃত্যুহার কম থাকবে।
বরগুনায় পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যে ৮ জন চিকিৎসক ও ২ জন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন আইইডিসিআরের পরিচালক।
তাহমিনা শিরিন আরও বলেন, আপনি যত চিকিৎসকই দিন বা হাসপাতাল বানান- যদি উৎস না বন্ধ করেন, তাহলে ডেঙ্গু কখনও নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
তিনি সবাইকে বাসাবাড়ির চারপাশে নজর রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমাদের নিজেদের ঘরেই লার্ভা আছে। আমরা যারা সচেতনতা নিয়ে কাজ করি, আমাদের বাড়িতেও খুঁজলে কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত, সুপেয় পানির সংকট মেটাতে বরগুনাবাসীর সংগ্রহ করা বৃষ্টির পানি এখন মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি শুধু বরগুনা নয়, গোটা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কতা। শুধু স্বাস্থ্যকর্মী বাড়িয়ে নয়, মানুষকে সচেতন করে পানি সংরক্ষণের পদ্ধতিতেও বড় পরিবর্তন আনতেই হবে- না হলে ডেঙ্গু হয়ে উঠবে আরও মারাত্মক মহামারি।