নিজস্ব প্রতিবেদক,
অসময়ে জালের ফাঁক দিয়ে ঝুলছে ছোট-বড় তরমুজ। দেশে মৌসুমি তরমুজের ভেতরটা লাল, কিন্তু এই তরমুজের ভেতরটা হলুদ। মৌসুমি তরমুজের চেয়ে অনেক বেশি মিষ্টি এই তরমুজ। এমন তরমুজের আবাদ করেছেন বরগুনা সদর উপজেলার কালীতবক গ্রামের আবদুল মান্নান।
কৃষি প্রযুক্তির ভাষায়, এই পদ্ধতির নাম সর্জান পদ্ধতি। সর্জান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে প্রথমে জমি থেকে মাটি কেটে দুই পাশে উঁচু আইল ও নিচে নালা তৈরি করতে হয়। এরপর আইলের উপর জৈব সার দিয়ে করলা, শসা, শিম, বরবটিসহ নানা রকম সবজি চাষ করা যায়। আবাদের জন্য এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা। নিচু, পতিত জমিকে বহুমুখী ব্যবহারের জন্য এই প্রযুক্তি দক্ষিণাঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।
এই পদ্ধতিতে একই সময় নালাতে তেলাপিয়া, রুই, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়। ফলে বর্ষাকালে যখন চারদিক পানিতে তলিয়ে যায় তখনও সবজি খেতগুলো অক্ষত থাকে। আবার শুষ্ক মৌসুমে যখন চারদিকে পানি থাকে না তখন নালা থেকে পানি উঠিয়ে সবজিখেতে ব্যবহার করা যায়। এতে সবজির ফলন ভালো হয়। সর্জান পদ্ধতিতে একই জমিতে একসাথে সবজি ও মাছ চাষ করে বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
কৃষক আবদুল মান্নান বলেন, অসময়ে এমন তরমুজ আবাদের উদ্যোগে তার দুই ছেলে আবদুল আলীম ও বনি আমিন। মৌসুমে প্রচুর তরমুজ উৎপাদিত হলেও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয় কৃষকেরা। তাই বিকল্প পদ্ধতিতে যদি মৌসুম ছাড়া তরমুজ উৎপাদন করা যায় তবে লাভবান হওয়া সম্ভব। এই চিন্তা থেকে বনি আমিন ইউটিউবে এ সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। পরবর্তীতে আমার (আবদুল মান্নান) ও ভাই আবদুল আলীমের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন বনি আমিন।
প্রথমত পরীক্ষামূলকভাবে ৮০ শতক জমিতে তরমুজ চাষের উদ্যোগ নেন। গত এপ্রিলে বাড়ির সামনের মাছের খামারে ৫০০ চারা রোপণ করেন আলীম ও তার পরিবার। এলাকার লোকজন এসব দেখে প্রথমে হাসিঠাট্টা করেন। কিন্তু তারা এতে পিছপা হন না। তাদের যত্নে চারাগুলো বেড়ে ওঠে। এরপর পুকুরে খুঁটি পুঁতে জাল দিয়ে লতাগুলো জালের ওপর তুলে দিলে সেগুলো তরতর করে বেড়ে উঠতে থাকে। এরপর আসে ফুল। ফুল থেকে ফল। কচি সবুজ–কালো ফলগুলো যখন আসে তখন শুরুতে যারা আলীমের এই কাজকে পাগলামি আখ্যা দিয়ে হাসিঠাট্টা করেছিলেন তারাও প্রতিদিন অসময়ে তরমুজ ফলার বিস্ময়ের ঘোরে ছিলেন। দেখতে দেখতে আলীম ৫০০ গাছে দেড় হাজার তরমুজ পেয়েছেন। একেকটির ওজন চার থেকে সাত কেজি।
বুধবার (৪ আগস্ট) আলীম জানান, ‘অসময়ে তরমুজ আবাদ করা যায়- এমন কথা ছোট ভাইয়ের কাছে শুনে আমি আর বসে থাকিনি। সেই কাজে নেমে পড়ি। কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে পরামর্শ করি। কাজটা যখন প্রথম শুরু করি, তখন অনেকে হাসিঠাট্টা করেছে। ফলে এটা আমার মনে এক ধরনের জেদ ধরে। সেই জেদের কারণেই বাবা-মা, দুই ভাইয়ের পরম যত্নে আমাদের সফলতা আসে।’
তিনি আরও জানান, দেড় হাজার তরমুজ উৎপাদন হয়েছে এবার। ওজনে চার থেকে সাত কেজি। আবাদ করতে শ্রম ছাড়া ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। দেড় হাজার তরমুজ প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন বাড়ি থেকেই।
বরগুনা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়া গেলে একদিকে যেমন তরমুজ সারাবছর পাওয়া যাবে, অন্যদিকে চাষিরাও লাভবান হবেন।
বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ২০১৭ সালে প্রথম ভাসমান সবজি ও ফল আবাদ প্রকল্পের অধীনে প্রথম পরীক্ষামূলক ‘বেবি ওয়াটার মেলন’ বা ছোট তরমুজের আবাদ শুরু হয়। সেটা ছিল আকারে ছোট, দু–এক কেজি ওজনের এবং হাইব্রিড প্রজাতির। এরপর এই ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে গতবছর দুটি দেশি জাত—বারি তরমুজ-১ ও ২ উদ্ভাবন করেন। সেটি লেবুখালী আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্বকেন্দ্রে আবাদ করে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এটা এখন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিএসডি/আইপি