নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফার্মগেট থেকে সাইনবোর্ডের দূরত্ব ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এ পথের ভাড়া ছিল ৩১ টাকা। লাব্বাইক পরিবহনের বাসে ভাড়া নেওয়া হতো ৪০ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আড়াই টাকা করেছে সরকার। গতকাল রোববার তা কার্যকর হওয়ার পর ফার্মগেট-সাইনবোর্ডের ভাড়া হয়েছে ৩৬ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। আগে বাড়তি নেওয়া হতো ৯ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ১৪ টাকা।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বহু ঘটনা দেখা গেছে। বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া বাড়েনি। ফার্মগেট থেকে পল্টন, গুলিস্তানের ভাড়া ১০ টাকা রয়ে গেছে। গতকাল বিকেলে ফার্মগেটে দেখা গেল, খাজাবাবা পরিবহনের বাস ১৫ টাকা ভাড়া চাইছে। বাসটির হেলপার বললেন, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনও তালিকা পাননি। তাই আপাতত ৫ টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন।
ফার্মগেট থেকে সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্কের দূরত্ব ৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার। ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ১৭ টাকা। আড়াই টাকা হিসাবে ভাড়া বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। কিন্তু আগেই নেওয়া হতো ২০ টাকা। গতকাল দুপুরে বাসের হেলপার চাইলেন ৪০ টাকা। রাজি না হলে হেলপার প্রস্তাব করলেন, ৩০ টাকা দিতে হবে। সাংবাদিক পরিচয় পেতেই না তুলে চলে যায় বাসটি। অপেক্ষমাণ ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বললেন, আগেও বেশি ভাড়া নিত। ভাড়া বাড়ানোর পরও বেশি নিচ্ছে।
ডিজেলের দাম এক লাফে ৩৪ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা লিটার হওয়ায় ঢাকায় বাসের ভাড়া ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২২ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়িয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শিবলি নোমান। তিনি সকাল সাড়ে ৮টার ক্লাস ধরতে সাভার থেকে সদরঘাটগামী বাসে ওঠেন। সদরঘাটের ভাড়া ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হওয়ায় তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া ২৫ টাকা। তাঁকে দিতে হয়েছে ৪০ টাকা।
সদরঘাট থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা রুটে চলে আজমেরী গ্লোরি পরিবহনের বাস। সরেজমিন দেখা যায়, স্টপেজপ্রতি ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। গতকাল থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। একটু এগিয়ে কাকরাইল ও শান্তিনগরে নামলে ২৫ টাকা নিচ্ছে।
মগবাজারে গেলে বাসের হেলপারের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয় যাত্রীর। সদরঘাট থেকে মগবাজারের ভাড়া আগে ছিল ৩০ টাকা। কিন্তু হেলপার ৪৫ টাকা দাবি করেন। যাত্রী ৩৫ টাকা দিতে রাজি হন। হেলপার বলেন, ভাড়ার তালিকা না আসায় কোম্পানি যা নির্ধারণ করেছে তাই আদায় করতে হচ্ছে। চালক নাসির মিয়া বলেন, ভাড়া না বাড়ালে তো তেলের খরচই উঠবে না।
গতকাল সকাল ৯টার দিকে মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে শিকড় পরিবহনে ফার্মগেট আসেন রাজন। আগে দিতেন ১৫ টাকা। রোববার হেলপার ২০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। ক্ষুব্ধ রাজন তালিকা দেখতে চান। বাসের চালক বলেন, ভাড়া বেড়েছে দেশের সবাই জানে। চার্ট লাগবে কেন? তালিকা না দেখে বাড়তি ভাড়া দিতে নারাজ রাজন। তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন অন্য যাত্রীরা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
সকাল সাড়ে ১০টায় ফার্মগেটে কথা হয় পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা লিয়াকত আলীর সঙ্গে। মামলার কাজে ঢাকার জজ আদালতে যাবেন। বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, আগে ২০ টাকায় যেতে পারতেন। বিহঙ্গ পরিবহন এখন ২৫ টাকা চাইছে।
যাত্রী ধরতে দূরপাল্লায় ভাড়া কম :সরেজমিন গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনাল ঘুরে দূরপাল্লার বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও অসঙ্গতি দেখা গেছে। দূরপাল্লায় ৫১ আসনের ভাড়া কিলোমিটারে ২ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ৪০ আসনের ক্ষেত্রে তা ২ টাকা ৮০ পয়সা। ঢাকা-রাজশাহী রুটের দূরত্ব ৩৩৬ কিলোমিটার। আগে এ পথে টোলসহ ৮০৭ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯৭৯ টাকা। হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মোহাম্মদ আকবর বলেন, আগে ৬০০ টাকা নিতেন। এখন ৭২০ টাকা নিচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিলে যাত্রী হবে না।
হানিফ পরিবহনে ঢাকা-ঠাকুরগাঁওয়ের ভাড়া ছিল ৯০০ টাকা। বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪০ টাকা। ঢাকা-গাইবান্ধার ভাড়া ৬০০ থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকা, ঢাকা-বগুড়ার ভাড়া ৪৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫৭০ টাকা করা হয়েছে।
গাবতলী থেকে বাগেরহাটের ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৯৩৭ টাকা। আগে ছিল ৭৬১ টাকা। গাবতলীর কমফোর্ট লাইন পরিবহনে আগে নেওয়া হতো ৬০০ টাকা। গতকাল থেকে নেওয়া হচ্ছে ৬৫০ টাকা। কাউন্টার ম্যানেজার মোহাম্মদ রাজু জানান, শুধু ঈদের সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়া নেওয়া হয়। বাকি সময় যাত্রী পেতে কম ভাড়া নিতে হয়। তিনি কৌতুক করে বলেন, ‘সরকারি রেটে ভাড়া নিলে যাত্রী একবার বাগেরহাট গেলে জীবনে আর ঢাকায় আসপে না।’
মহাখালী টার্মিনাল থেকে চলা ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১১৬ কিলোমিটার পথে ৪০ আসনের বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ছিল ২৬৬ টাকা। কিন্তু লোকাল হিসেবে চলা ‘সৌখিন পরিবহন’ নিত ১৫০-২০০ টাকা। এখন নিচ্ছে ২৫০ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি বর্ধিত হিসেবে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ভাড়া হবে ৩২৫ টাকা।
ঢাকা-সিলেট রুটে শ্যামলী এনআর পরিবহনের বাসে ভাড়া ছিল ৫৭০ টাকা। এখন নিচ্ছে ৭৫০ টাকা। এই পরিবহনের ৩৬ আসনের বাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৭৫৪ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি নিচ্ছে ৭৫০ টাকা। আগে ছিল ৫৭০ টাকা। শ্যামলী এনআরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকেশ ঘোষ সমকালকে বলেছেন, আগের কম ভাড়াতেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন বাড়তি ভাড়ায় যাত্রী আরও কমবে। তাই কেউই সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি নেওয়ার সাহস করবে না।