নিজস্ব প্রতিবেদক
- অভিযোগ জমা পড়েছে মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে
- আওয়ামী সরকারের আমলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা
- ভোল পাল্টে সেজেছেন বিএনপিপন্থী নেতা
- অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করছে দুদক
- টেন্ডারের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করায় ঠিকাদারকে হুমকি
- নামে বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
- সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ড্রেজিং এর প্রধান প্রকৌশলী হওয়ায় বিতর্ক

আওয়ামীলীগ নেতা মির্জা আজমের সাথে রাকিবুল ইসলাম তালুকদার
খোদ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়েছে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রাকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে। আওয়ামী সরকারের আমলে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা। এ সংগঠনের হয়ে ফুল দিতেন শেখ মুজিবের মাজারেও; নিয়মিত অংশ নিতেন তাদের সভা সমাবেশে। সখ্যতা ছিল এইচ টি ইমাম, মির্জা আজম, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক এমপি শেখ হেলাল, লিটন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের সাথেও। এসবের অনেক স্থিরচিত্রও রয়েছে প্রতিবেদকে হাতে। তবে অবাক করা বিষয় হলো- গত পাঁচ আগস্টের পর তিনি সেজেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলপন্থী কর্মকর্তা। তাকে নিয়ে দুদকে চলা অনুসন্ধানে প্রভাব বিস্তার করায় পাঁচ বছরের শেষ করতে পারেনি তদন্ত কাজ। এদিকে একটি দরপত্রের অনিয়ম নিয়ে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জমা দিলে অভিযোগকারিকেও দিয়েছেন হুমকি। দিয়েছেন অকথ্য ভাষায় গালিও। সপ্রতি এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন ওই ভুক্তভোগী।

সম্প্রতি নৌ এক ঠিকাদারকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ায় রাকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি
সম্প্রতি নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও দুর্নীতি দমক কমিশনে করা (দুদক) অভিযোগে এসব চিত্র উঠে এসেছে৷
এদিকে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে,বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার ঘুষ, দুর্নীতি আর বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশনের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ঢাকার রাজউক পূর্বাচলে ৭.৫ কাঠার ২টি প্লট, গাজীপুরে ৫ একর শালবাগান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩টি প্লট, টঙ্গী এলাকায় ১০ কাঠার জমি, টাঙ্গাইলে স্থায়ী ঠিকানায় ৬ তলাবিশিষ্ট ৩টি আলিশান বাড়ি, ১০ একর জমির শালবাগান, ১৫৭ আইডিয়াল হোমস, ঢাকার শান্তিনগর-পল্টন এলাকায় ৩৭০০ বর্গফুটের ৪টি ফ্ল্যাট, ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে আমিন মোহাম্মদ হাউজিং, প্রিয়াঙ্কা সিটিতে ৪টি প্লটসহ গুলশান, বনানী, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আলিশান ফ্ল্যাট। এগুলো তিনি নামে-বেনামে নিকট আত্মীয়দের নামে কিনেছেন। এ ছাড়াও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ৭ কোটি টাকা। তিনি সরকারি অর্থ অপচয় করে একাধিকবার এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ করে হুন্ডির মাধ্যমে শত শত কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে শেখ মুজিবুর রহমানের মুরালে ফুল দিচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রাকিবুল ইসলাম তালুকদার
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, শুধু হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার জন্য অপ্রয়োজনীয় এই প্রকল্পগুলো সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় হাতে নিয়েছিল। বাস্তবে এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। প্রকল্প পরিচালক বাস্তবে সামান্য কিছু ড্রেজিং করেছেন। কিন্তু কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে বাস্তবের চেয়ে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বেশি কাজ। এর মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ চক্র আত্মসাৎ করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিতে বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ থাকলেও এ বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পের ড্রেজিংয়ের জরিপ করানো হয় না। অভিযোগ রয়েছে, কোটি কোটি টাকা অপচয় করে বেসরকারি কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের জরিপ করানো হয়। এই বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক রকিবুল ইসলাম তালুকদার তার ইচ্ছে অনুযায়ী মাটির পরিমাণ বৃদ্ধি করে শতকোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
এ নিয়ে রকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তদন্ত কাজে বাধা দেওয়ায় সে তদন্তটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার ১০ বছর ধরে ড্রেজিং বিভাগে কর্মরত। এ সময়ে তিনি ড্রেজিং বিভাগের ৩৫টি ড্রেজারসহ ২০০টি বিভিন্ন ধরনের সহযোগী জাহাজ, জলযান মেরামত, তেল চুরি, ড্রেজিং ঠিকমতো না করে ভুয়া বিল প্রস্তত করা, টেন্ডার সিডিউল অনুযায়ী নেদারল্যান্ডস, আইএইচসি, আমেরিকার ড্যামেন কোম্পানির ড্রেজার মেশিন ক্রয় না করে দেশীয় যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিম্নমানের ড্রেজার, মেশিন ও জলযানগুলো প্রায় সময়ই বিকল হয়ে থাকে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ভাগ্নি জামাই। ২০১৮ সালে দুদকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে দুদক তদন্তও শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলেও তিনি ক্ষমতার দাপটে অনুসন্ধান ধামাচাপা দেন। সরকার পতনের পর বর্তমানে তার বিরুদ্ধে দুদকে আরেকটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের হয়ে ফুলের শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন রাকিবুল ইসলাম তালুকদার
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দুদক প্রধান কার্যালয়ের (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০৩.০৮.২৪/২০১৫) মোতাবেক ২০২৩ সালের ৮ জুলাই দুদকের বিশেষ তদন্ত ও অনুসন্ধান-১ শাখার সহকারী পরিচালক মো. খোরশেদ আলম, প্রকৌশলী রকিবুল ইসলাম তালুকদার, তার স্ত্রী-সন্তান এবং তার ওপর নির্ভরশীল পরিবার এবং ব্যক্তিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী দাখিলের জন্য পত্র জারি করেন। সাবেক আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় নোটিস অনুযায়ী সম্পদের হিসাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল না করলেও দুদক আইন অনুযায়ী রকিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। রকিবুল ইসলাম তালুকদার তার স্ত্রীকে বিআইডব্লিউটিএর একজন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ দেখিয়ে ভুয়া বেতন-ভাতাদি গ্রহণ দেখিয়ে এবং বিগত কয়েক বছরের আয়কর নথি যোগসাজশে পরিবর্তন করে শতকোটি টাকা সাদা করেছেন। অভিযোগগুলো তদন্ত করে রকিবুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়ে এক ভুক্তভোগী প্রধান উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করেছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনে রাকিুল ইসলাম তালুকদারের নথি
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ১৯২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (১ম সংশোধিত ২৪টি নৌপথ) প্রকল্পে শর্তসাপেক্ষে প্রেষণে রফিকুল ইসলামকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়। সংশোধিত ২৪ নৌপথ ড্রেজিং প্রকল্পের দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিটি প্যাকেজে ১০ শতাংশ করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের ক্ষমতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই, পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধার শীর্ষ’ প্রকল্পে ৪ হাজার ৩৭১ কোটি ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রকিবুল ইসলাম তালুকদার নিয়োগ পান। তিনি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ড্রেজিং এর প্রধান পদে নিয়োগ পাওয়ায়ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে খোদ বিআইডব্লিউটিএ ভবনে৷
এদিকে বিআইডব্লিউটিএর একটি দরপত্রের অনিয়ম নিয়ে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করায় অভিযোগ তুলে নিতে হুমকিসহ প্রাননাশের হুমকি দিয়েছেন রাকিবুল ইসলাম তালুকদার।
এ নিয়ে তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন ওই ভুক্তভোগী। এদিকে বিআইডব্লিউটিতে ক্ষমতার অপবাবহার, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি করার দায়ে দশ বছর আগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। কিন্তু সে অনুসন্ধানে প্রভাব ফেলাতেও আলোর মুখ দেখেনি। নির্ধারিত মানদণ্ডে কাজ না করেও ২০ কোটি টাকা আত্নসাত করার দায়ে ২০১৮ সালেও তার বিরুদ্ধে আবারও অনুসন্ধানে নামে দুদক। কিন্তু রাকিবের কারিশমায় এ পর্যন্ত কোন তদন্ত আলোর মুখ দেখেনা।
সূত্র- রুবা/প্রবা/এসকে/নদি