নিজস্ব প্রতিবেদক:
সরকারের রাজস্ব বাড়াতে চলতি অর্থবছরে সব ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ কেনাবেচার ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে নির্ধারিত ট্যারিফের ওপর ৬ শতাংশ এবং বিতরণকারী সংস্থা বা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত বাল্ক ট্যারফের ওপর অতিরিক্ত ৬ শতাংশ উৎসে আয়কর অর্থাৎ মোট ১২ শতাংশ আয়কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ নিয়মের ফলে বিদ্যুতের খুচরা দর বেড়ে যাবে। যার ফলাফল হিসেবে বাড়বে গ্রাহকদের জীবনযাত্রার ব্যয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নতুন এ কর আরোপের বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই এ কর প্রত্যাহার চেয়ে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
নভেল করোনাভাইরাসজনিত মহামারীর পর দেশের অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে তাতে এ সময় নতুন করে করারোপ করা উচিত নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বরং সরকারের উচিত সাময়িক সময়ের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড় দেয়া।
যাতে বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের মানুষের একটি বড় অংশ যে সমস্যায় পড়েছে, তা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মেলে। তবে এখনো বিদ্যুতের নতুন কর প্রত্যাহারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এনবিআর। বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নিজাম উদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, অতিরিক্ত ১২ শতাংশ করের ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়বে। তাই বিদ্যুৎ বিভাগ এ কর প্রত্যাহার চায়। সেটি জানিয়ে এনবিআরে চিঠিও লেখা হয়েছে। তবে এনবিআর এখনো তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি।
এনবিআরে পাঠানো চিঠিতে বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে শুল্ককর মওকুফসহ সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে আসছে। ফলে গত দশকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছর অর্থাৎ অর্থ আইন, ২০২১-এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫২এন ধারাটি প্রতিস্থাপন করে সব বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রেতার ৬ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের নেয়া নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৫২এন ধারার পূর্ববর্তী বিধান অনুসারে কেবল বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কর্তৃক রেন্টাল পাওয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ উৎসে আয়কর কাটার বিধান ছিল। কিন্তু অর্থ আইন, ২০২১-এর মাধ্যমে ওই ধারাটি প্রতিস্থাপন করে বিপিডিবিসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী সংস্থার প্রতিটি বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখার বিধান করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বিদ্যুৎ খাতের বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা কাঠামো অনুসারে একই বিদ্যুৎ কয়েক দফা ক্রয়-বিক্রয় করতে হয়। বিদ্যমান আইন অনুসারে যেহেতু সব উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিপিডিবির কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাই বিদ্যুৎ বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনতে পারে না। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে বিপিডিবি প্রথমে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয়। এরপর সেই বিদ্যুৎ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত দরে পুনরায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়। নতুন প্রতিস্থাপিত ৫২এন ধারা অনুসারে ক্রেতা হিসেবে প্রথমে বিপিডিবিকে ৬ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর দিতে হয়। একই বিদ্যুতের ক্রেতা হিসেবে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকেও ৬ শতাংশ হারে উৎসে আয়কর দিতে হয়। এ দ্বৈত করারোপ আয়করের মূলনীতি ও দর্শনের পরিপন্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য সামস উদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সেটি জানিয়ে দেয়া হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উপকরণ তথা গ্যাস ও জ্বালানির জন্য বিক্রয়মূল্যের সিংহভাগ অর্থ খরচ করতে হয়। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৫৩ ধারা অনুসারে এ গ্যাস ও জ্বালানি আমদানি পর্যায়েই অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হয়। নতুন প্রবর্তিত বিধান অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীকে গ্যাস ও জ্বালানি আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর পরিশোধের পরেও আবার বিক্রয়মূল্যের ওপর ৬ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যমান আইন অনুসারে বিপিডিবি উৎপাদনকারী ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করলেও প্রক্রিয়াগত কারণে বিতরণকারী কোম্পানির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রয়কারী হিসেবে গণ্য হয়। তাই সংস্থাটি আবারো ৬ শতাংশ হারে উৎসে করের আওতায় পড়ে যায়।
আয়কর বা করপোরেট কর মূলত আয়ের ওপর দিতে হয়। বিদ্যুৎ একটি ‘পাবলিক গুডস’ হওয়ায় এর বাজারমূল্য ব্যবসায়িক সূত্র প্রয়োগ করে নির্ধারণ করা হয় না। বরং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করা হয়। ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হলেও গ্যাস-জ্বালানি আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর পরিশোধের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের মোট টার্ন ওভারের ওপর দুবার করারোপ করা হয়।
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী কোম্পানিগুলো নিয়মানুযায়ী কোম্পানি আইনে পরিচালিত হয়। উৎপাদন ও বিতরণ খাতে কোম্পানিগুলো নিয়মিতভাবে তাদের করপোরেট আয়ের ওপর করপোরেট কর পরিশোধ করবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু নতুনভাবে প্রতিস্থাপিত ৫২এন ধারার কারণে প্রদেয় করের কয়েক গুণ বেশি কর পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে নির্ধারিত ট্যারিফের ওপর ৬ শতাংশ এবং বিতরণকারী সংস্থা বা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত বাল্ক ট্যারিফের ওপর অতিরিক্ত ৬ শতাংশ আয়কর অর্থাৎ মোট ১২ শতাংশ আয়কর যোগ করলে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য অনেক বেড়ে যাবে। এতে গ্রাহকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সর্বোপরি ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ বাস্তবায়ন এবং সরকার তথা বিদ্যুৎ বিভাগের মিশন অনুযায়ী সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। তাই বিদ্যুৎ বিভাগ অতিরিক্ত কর আরোপ প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, এনবিআরের উচিত সরকারি-বেসরকারি যেকোনো কোম্পানির ওপর একই নীতিতে করপোরেট কর প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে কোনো রকমের উৎসে কর গ্রহণযোগ্য নয়। কোম্পানিগুলো ভ্যাট দেয়, তাহলে আবার উৎসে কর কেন আদায় করতে হবে—সে প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ কর আদায়কে অনুচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো আন্তর্জাতিক পদ্ধতি নয়। এ ধরনের পদ্ধতিতে কর আদায় করা উচিত হবে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়তে পারে। দাম বাড়লে সরকার অতিরিক্ত কিছু রাজস্ব পায়। সুতরাং বাড়তির বাজারে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্সে কিছুটা ছাড় দিতেই পারে। এমনও হতে পারে আগামী তিন মাস আমদানি পর্যায়ে পুরো করই তুলে নিল সরকার। তাহলে আমদানি খরচ কমে যাবে এবং পণ্যের দাম কমায় জনগণ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
বিএসডি/ এফএস