দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। দ্রুত সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ইউকে ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করেছেন। করোনার এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমিত করার ক্ষমতা মূল ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। এদিকে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লকডাউনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে সরকার। তবে এই লকডাউনকে সাধারণ ছুটি মনে করে মানুষ গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শুরু করলে সারাদেশে করোনার ভয়াবহতা ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
রাজধানীতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউনের খবর জানার পর গতকাল বিকেল থেকে সদরঘাট ও বাস টার্মিনালগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়ছে। লকডাউনে আটকা পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় তারা আগেভাগে রাজধানী ছাড়ছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে খবর নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার জন্য যাত্রীদের ভিড় লেগেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছে। ঘরমুখো এসব মানুষের মধ্যে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিকসহ নিম্নআয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। যাত্রীদের ভিড়ের কারণে অনেক পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ যেসব জায়গায় ভিড় আছে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া বা সেগুলোর ক্যাপাসিটি অর্ধেক করে ফেলার জন্য বলা হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা মানুষকে ঘরে থাকার জন্য উপদেশ দেই। কিন্তু লকডাউনের ঘোষণার পর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই লকডাউন। কিন্তু এর মধ্যে যদি যাতায়াত বেড়ে যায়, তাহলে তো হলো না। এতে গ্রামে গ্রামে নতুন প্রজাতির সংক্রমণ ছড়াবে। যা আমাদের জন্য আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই যেকোনো মূল্যে এই সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কানাডার সিনিয়র পলিসি বিশ্লেষক ডা. শাহরিয়ার রোজেন বলেন, লকডাউন ঘোষণার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষকে গ্রামমুখী হওয়া থেকে বিরত রাখা। লকডাউনকে মানুষ সাধারণ ছুটি মনে করে গ্রামের বাড়িতে গেলে চরম সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ তারা ঢাকা শহর থেকে সঙ্গে করে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে যেতে পারে। ইউরোপের তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য দায়ী এই মারাত্মক ভ্যারিয়েন্ট যা ৩০-৫০ শতাংশ বেশি সংক্রামক ও ৫৫ শতাংশ বেশি প্রাণঘাতী। যেকোনো মূল্যে মানুষকে গ্রামমুখী হওয়া প্রতিহত করতে হবে।
ডা. শাহরিয়ার রোজেন বলেন, সব দেশের জন্যই লকডাউন বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী পরিকল্পনা, যথাযথ প্রয়োগ এবং সঠিক সমন্বয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, অধিদফতরের পক্ষ থেকে ১২ দিনের সম্পূর্ণ লকডাউনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার বলেছে প্রথম এক সপ্তাহ হবে। তারপর পরিস্থিতি দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, লকডাউনের সময় অত্যাবশ্যকীয় সেবা চালু ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ থাকবে। এছাড়া গণপরিবহন, দূর পাল্লার বাস, লঞ্চ, বিমান ও ট্রেন চলবে কি না সে বিষয়ে আজ (রোববার) প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হতে পারে।
এদিকে, রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনালসহ ঢাকার বিভিন্ন বাস কাউন্টারে দেখা গেছে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড়। যাত্রীদের চাপে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানকার বাস কাউন্টারের দায়িত্বরতরা।
সায়েদাবাদের হানিফ ও শ্যামলী কাউন্টারের দায়িত্বে পালনকারীরা বলেন, লকডাউনের খবর শুনেই শনিবার দুপুর থেকে যাত্রীরা ফোন দিয়ে টিকিট বুকিং নেওয়া শুরু করেছেন। যাত্রীদের ফোনের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই রোববার রাত পর্যন্ত সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। লকডাউনের খবরে যাত্রীদের যতটা চাপ সামলাতে হচ্ছে ঈদের ছুটিতেও এত চাপে পড়েন না।
একই অবস্থা মহাখালী বাস টার্মিনালেও। সেখানকার কয়েকটি কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতারা বলেন, হঠাৎ করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় বাসের অর্ধেক আসনে যাত্রী বহনের নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে যাত্রীদের চাপ অনেক বেড়েছে। এখন লকডাউন ঘোষণায় যাত্রীদের চাপ আরও বেড়েছে। গতকালের তুলনায় আজও (রোববার) যাত্রীর চাপ অনেক বেশি বাড়তে পারে।
বন্ধ থাকছে অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট: লকডাউন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ সব রুটের ফ্লাইট বন্ধ থাকছে। শনিবার (৩ এপ্রিল) বিষয়টি নিশ্চিত করেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সোহেল। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের সময় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি লকডাউন চলাকালীন অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকবে। সরকার যেদিন থেকে লকডাউন কার্যকর করবে সেদিন থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’
যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলও বন্ধ: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতি হওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারাদেশে লকডাউন দিচ্ছে সরকার। লকডাউনে মালবাহী ছাড়া যাত্রীবাহী সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
শনিবার বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে সোমবার সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান বন্ধ থাকবে। তবে মালবাহী জাহাজ চলাচল করবে।
লকডাউনে বন্ধ থাকছে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল: লকডাউনে জরুরি খাদ্য ও পণ্যবাহী ট্রেন ছাড়া সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে শিগগিরই। বিষয়টি জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, লকডাউন শুরু হবে সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে। লকডাউনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি খাদ্য ও পণ্য পরিবহন করা হবে।
বন্ধ থাকবে দোকানপাট-শপিংমল: লকডাউনের সময় সব দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ থাকছে। ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুর রহমান টিপু এ বিষয়ে বলেন, লকডাউনের বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমাদের মানতেই হবে। কারণ দেশের করোনা পরিস্থিতি এখন ভালো না। তাই আগামী ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিংমল বন্ধ থাকবে। তবে আমাদের দাবি এই লকডাউন এক সপ্তাহের বেশি যেন না বাড়ে।
তিনি আরও বলেন, এর আগে সরকারের নির্দেশনা অনুসারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা শপিংমল ও দোকানের ব্যবসা পরিচালনা করেছি। নতুন করে যদি এর সঙ্গে কিছু যোগ করে তাও আমরা মানতে রাজি। তবে ঘোষিত লকডাউনের সময় যেন আর না বাড়ে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। কারণ এক সপ্তাহ পর সময় বাড়ালে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
এ বিষয়ে বসুন্ধরা সিটি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (অ্যাকাউন্ট) শেখ আব্দুল আলিম বলেন, লকডাউনের ঘোষণা এসেছে। তবে এখনও পর্যন্ত পুরো নির্দেশনা পাইনি। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে সেভাবেই আমরা চলব। শপিংমল এক সপ্তাহ বন্ধ রাখতে বললে আমরা বন্ধ রাখব।
প্রসঙ্গত, করোনা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। সংক্রমণ রোধে সারাদেশে লকডাউনের কথা জানিয়েছে সরকার। শনিবার করোনায় আরও ৫৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল নয় হাজার ২১৩ জনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৬৮৩ জন। এতে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ছয় লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জনে।