বর্তমান সময় প্রতিবেদন:
গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত তিন বছরে গ্যাস, এলপিজি গ্যাস ও সিলিন্ডার থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২ হাজার ১৫২টি। এসব দুর্ঘটনায় অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৩৯ জন। বড় দুর্ঘটনার পর এ নিয়ে তোড়জোড় হলেও কিছুদিন গেলেই চোখে পড়ছে পুরোনো উদাসীনতা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসলাইনের ক্ষেত্রে লিকেজ (ছিদ্র) ও সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ব্যবহারে অসচেতনতাই বড় বিপদ ডেকে আনছে। তদারক সংস্থাগুলোর দায়িত্বে গাফিলতি ও অব্যবস্থাপনায় এই বিপদ প্রকট আকার ধারণ করেছে। ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে মনিটরিং জোরদার করলে এই দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন তারা।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গত তিন বছরে ১৪টি বড় ধরনের গ্যাস দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে যুগান্তর। যেখানে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বদ্ধ রুমে মিথেন গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে হাইড্রোজেন সালফাইড যুক্ত হয়ে গ্যাস বিস্ফোরণকে আরও শক্তিশালী করে।
এসব বিস্ফোরণে বিপুলসংখ্যক হতাহতের পাশাপাশি ভবন ধসে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। চলতি বছরে গ্যাস থেকে এমন কয়েকটি দুর্ঘটনা ভয়ের জন্ম দিয়েছে। যেখানে একেকটি বিস্ফোরণ আশপাশের অন্যান্য স্থাপনাও কাঁপিয়ে দিয়েছে। আর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ, তাপ ও ছিদ্র থেকেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, দুর্ঘটনাগুলোর আগে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস জমা হয়। মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমে বাতাসে ৫-১৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোনো স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ), ম্যাচের কাঠি বা আগুনের উৎস থাকলেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে যুক্ত হয় হাইড্রোজেন সালফাইড। যা নিজে দাহ্য না হলেও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য হয়। মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড এক হয়ে বেড়ে যায় দাহ্যতা। সে কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনও ধসে যেতে পারে।
গত ২৭ জুন মগবাজারের শরমা হাউজে সবচেয়ে আলোচিত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন অর্ধশতাধিক। সেদিন বিকট শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল তিনতলা ভবনটি। শক্তিশালী এ বিস্ফোরণের ধাক্কায় রাস্তার উলটোপাশের বেশ কয়েকটি ভবন ও যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি বাসসহ যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হঠাৎ এই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল মগবাজারের কিছু এলাকা।
পরে একাধিক সংস্থার তদন্তে উঠে আসে ভবনে জমে থাকা গ্যাস থেকেই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টা ৪৩ মিনিটে পুরান ঢাকার আলুবাজারে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে একটি চারতলা ভবনের আংশিক ধসে পড়ে। এতে তিনজন আহত হন।
সিলিন্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত সিলিন্ডারগুলো পুরোনো। এগুলো মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে বাইরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস ভর্তি করলে অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গ্যাস ধারণের ক্ষমতা হারিয়েও সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। অনেকে আবার বাসাবাড়িতে চুলার কাছে সিলিন্ডার স্থাপন করেন। এতে সরাসরি সিলিন্ডারে তাপ প্রবাহিত হয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। কেউ কেউ অসাবধানতাবশত সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করতে ভুলে যায়। এভাবে গ্যাস বাইরে এসেও ঘটে দুর্ঘটনা।
গ্যাস দুর্ঘটনার গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দিন যতই যাচ্ছে এই বিপদ ততই প্রবল হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে গ্যাস, এলপিজি গ্যাস ও সিলিন্ডার থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২ হাজার ১৫২টি। এসব দুর্ঘটনায় অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৪৩৯ জন।
এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গ্যাস থেকে অন্তত ৫৩৭টি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ২১৭ জন আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ২৬ জন। ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৩১৭ জনের। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৩৭৪ জন। এদের বড় অংশ গ্যাস দুর্ঘটনার শিকার।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, লাইনের গ্যাসের ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ সংযোগই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। গ্যাসের যে লাইনগুলো আছে এর বেশির ভাগই পুরোনো। এসব লাইন থেকে গ্যাস বের হয়ে বাতাসে মিশে এটা এক্সপ্লোসিভ (বিস্ফোরক) হয়ে যায়। তখন এতে একটা স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) পেলেই ঘটে দুর্ঘটনা। গ্যাস যত বেশি জমা হবে এর ভয়াবহতাও তত বাড়বে। আর সিলিন্ডার গ্যাসের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে প্রধানত মানহীন রেগুলেটর থেকে গ্যাস বের হয়ে। দীর্ঘক্ষণ গ্যাসের মধ্যে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যায় বলে লিকেজের বিষয়ও বুঝতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এর থেকে উত্তরণে গ্যাসলাইনের ম্যাপিং প্রয়োজন। তাছাড়া ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামত, মানসম্পন্ন সামগ্রীর ব্যবহার, ‘অটো শাটডাউন সিস্টেম’ চালু অতীব জরুরি।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইন ও সিলিন্ডার থেকে অন্তত ৭৯৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৫৩৪টি দুর্ঘটনা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। যেগুলো ফায়ার সার্ভিসের প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসে। এসব দুর্ঘটনায় আনুমানিক ২৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এই দুর্ঘটনাগুলোতে আহত হন ১৫৩ জন ও নিহত হন ১৬ জন। এর মধ্যে গ্যাস সরবরাহ লাইনের আগুনে আহত হন ৪০ জন ও নিহত হন ৪ জন। গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনায় ৬৭ জন আহত হন এবং নিহত হন ৬ জন। গ্যাস থেকে অগ্নিকাণ্ড ছাড়া বিস্ফোরণসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় ৪৬ জন আহত এবং ৬ জন নিহত হন।
এছাড়া ২০১৯ সালে গ্যাস, এলপিজি গ্যাস ও সিলিন্ডার গ্যাস থেকে অন্তত ৮১৮টি অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ হয়। এর মধ্যে ৩৭২টি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে যুক্ত হতে হয়েছে। বছরটিতে গ্যাস থেকে অগ্নিকাণ্ডে মোট ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১২ কোটি ১৫ লাখ ১২ হাজার টাকা।
এসব অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬৯ জন এবং নিহত হয়েছেন ২৫ জন। এই বছর ঢাকায় সর্বোচ্চ ৫৪৮টি এবং বরিশাল ও সিলেটে সর্বনিম্ন ৭টি করে গ্যাস থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনাগুলো কমিয়ে আনতে করণীয় উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. এএস মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে যেসব উৎস থেকে গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে এর সবগুলোই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সাধারণত এই বিস্ফোরণের উৎস হলো গ্যাস সিলিন্ডার ও লাইনের গ্যাস। এগুলোর লিকেজসহ অন্যান্য দুর্বলতা দূর করতে হবে। পাশাপাশি যেই উৎসগুলো থেকে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, তার তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে। এগুলোর পরিপূর্ণ ডাটাবেজ নেই। ফলে নিয়মিত মনিটরিং হয় না। কোথাও কোথাও কখনোই মনিটরিং হয় না। এটা একদমই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। এজন্য একটা পরিপূর্ণ ডাটাবেজ এবং এর একটা ম্যাপিং থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। তাহলে পরিদর্শকদের তদারকিতে ঘাটতি হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হায়ার অথোরিটির কাছে বার্তা আসবে। এ সময় তিনি যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন তাদের কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ফায়ার সার্ভিসের ছয় সুপারিশ : চলতি বছর মগবাজার বিস্ফোরণের পর গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা রোধে ছয়টি সুপারিশ করে ১৩ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায় ফায়ার সার্ভিস। যদিও সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের তিতাস গ্যাসের ভূগর্ভস্থ পুরোনো লাইনগুলো পরিবর্তন করে নতুনভাবে বিন্যাস করতে হবে।
কোনো ভবন বা স্থাপনা নির্মাণের সময় ভূগর্ভে গ্যাসলাইন নেই-তিতাস গ্যাস থেকে এমন সার্টিফিকেট নিতে হবে। সিটি করপোরেশনের ড্রেইন মেরামতকালে গ্যাসলাইন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। গ্যাসলাইন লিকেজ বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা জানতে তিতাসকে লাইনগুলো নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। লিকেজ পেলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে হবে।
বাসা-বাড়ি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রান্নাঘরে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। গ্যাস লিকেজ থাকলে কোনোভাবেই বৈদ্যুতিক সুইচ, মশা মারার ব্যাট, মোবাইল ফোন এগুলো ব্যবহার করা যাবে না, ধূমপান করা যাবে না। ঢাকা শহরে যেসব সুয়ারেজ লাইন আছে সেখানে যাতে গ্যাস লিকেজ হয়ে ওই লাইনের গ্যাসের সঙ্গে না মিশতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিএসডি/ এলএল