নিজস্ব প্রতিবেদক:
আসন্ন রমজানকে ঘিরে দেশে যে সব ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে সে সব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এবার রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য, যেমন ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডালের প্রচুর সরবরাহ আছে। ফলে রোজায় ভোগ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতির আশঙ্কা নেই। দেশে ১৮ মার্চ পবিত্র শব-ই-বরাতের পর রোজার নিত্যপণ্যের মূল বেচাকেনা শুরু হবে। সাধারণত রোজা উপলক্ষে যে সব পণ্য বেচাকেনা হয়, তা আমদানি হয় এর আগের দুই থেকে আড়াই মাসে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দরে কোন ধরনের জট না থাকায় এবার বেশ নির্বিঘ্নে ভোগ্যপণ্য আমদানি করে জাহাজ থেকে নামিয়ে নিজেদের গুদামে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে বন্দর ঘিরে তাদের বাড়তি পরিবহন খরচ করতে হয়নি। এ দিকে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, খেজুর, ফলমূল এবং চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র স্থাপনের মার্জিন শূন্যপর্যায়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজা উপলক্ষে পণ্য দেশে আসার পর বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। এই সুযোগে দেশের বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম আরও বাড়ার পাঁয়তারা করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ছোলা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র দুই হাজার টন কম। যদিও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছে আরও প্রায় ২৮ হাজার টন ছোলা। চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হওয়া ছোলার গড় দাম পড়েছে প্রতিকেজি ৫৫ টাকা, যা আগের দুই মাসের তুলনায় কেজিপ্রতি মাত্র এক টাকা বেশি। বাজারে এখন সাধারণ ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭০ টাকায়। একটু ভাল ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭৫ টাকা। গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর একই সময়ে সয়াবিন তেল, পামতেল, সয়াবীজ, গম, চিনি, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের আমদানি বেড়েছে। গতবারের তুলনায় এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে মসুর ডালের আমদানি ৫০ হাজার টন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন। সেই সঙ্গে বেড়েছে আমদানি মূল্যও। গত বছর খোসাসহ মসুর ডালের আমদানি মূল্য ছিল গড়ে কেজিপ্রতি ৪৯ টাকা। এবার কেজিপ্রতি ২৭ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৬ টাকা। অবশ্য মার্চে আসা নতুন চালানের আমদানি মূল্য আরও বেড়ে প্রতিকেজি গড়ে ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত বছরের চেয়ে এ বছর মসুর ডালের গড় আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি ৩২ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে বড় ও মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৯৫ থেকে ১১৫ টাকা দরে। গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম দুই মাসে মটর ডালের আমদানি মূল্য ৭ টাকার মতো বেড়ে গড়ে কেজি ৩৭ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিপরীতে বাজারে দাম ইতোমধ্যে ১০ টাকা বেড়েছে। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। অপরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতিকেজি গড়ে ১১ টাকা বেড়ে প্রায় ৩৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। খুচরা বাজারে এখন চিনির দাম কেজি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে। এক বছরে খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি প্রায় ৫৪ থেকে ৫৫ টাকা। আর বোতলের তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দুই মাসের হিসাবে গত বছরের তুলনায় পাম তেলের আমদানি মূল্য বেড়েছে লিটারপ্রতি ৩২ টাকা। বাজারে দাম বেড়েছে ৫০ টাকার বেশি। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে লিটারপ্রতি ১৫৩ থেকে ১৬৫ টাকায়। এখন খোলা সয়াবিন ও পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বাজারদরের তালিকায় উল্লেখ করছে টিসিবি।
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজ আমদানিও দ্বিগুণ হয়েছে, পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার টন। এদিকে, এখন থেকেই বাজারে লাগাম টানতে নতুন করে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (ইমপোর্ট পারমিট-আইপি) দিয়েছে সরকার। হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন-অর রশীদ বলেন, দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে পাওয়া অনুমতিপত্রের (আইপি) মাধ্যমেই আমদানি বাড়িয়েছেন আমদানিকারকরা। আবার নতুন করেও আইপি দেয়া হচ্ছে। এতে করে পেঁয়াজের দাম এখনও অনেকটাই হাতের নাগালে রয়েছে। আমদানির এমন ধারা অব্যাহত থাকলে আসন্ন রমজানে দাম বাড়ার আশঙ্কা নেই।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজান মাসের কেনাবেচা শুরু হলে আমদানিকারকরা বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন। এবার যেহেতু রোজা উপলক্ষে পণ্য দেশে আসার পর বিশ্ববাজারে দাম আরও বেড়েছে, সেহেতু সেই সুযোগ নেয়ার আশঙ্কা বেশি। তা ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে সরবরাহ ঘাটতির আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স তৈয়বিয়্যা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান বাদশা বলেন, ছোলাসহ রমজানের সব পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও সরবরাহ রয়েছে। তবে বিশ্ববাজার থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে আগের চেয়ে বেশি দামে। এরপরও বুকিং দর বৃদ্ধির অজুহাতে রমজানকে ঘিরে আমদানিকারকরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোজায় আর যাতে দাম না বাড়ে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ভোগ্যপণ্যের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের ডিরেক্টর অপারেশন তারিক আহমেদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন অর্থাৎ কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে যে সব পণ্য আমদানি হয়, সেগুলো বাদে রোজার পণ্যের সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। সরবরাহ সঙ্কট না হলে পণ্যের দামেও অস্থিরতা থাকে না। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে দাম যা বাড়ার, তা ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। নতুন করে বাড়ার কারণ নেই।
কনজুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকেন। তারা বর্তমানে যে উচ্চমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন, তা কিন্তু অনেক আগেই আমদানি করা হয়েছে। তখন জিনিসপত্রের দাম এত বেশি ছিল না। তিনি বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দাম বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। বাংলাদেশের বাজারে যুদ্ধের প্রভাব আরও ১-২ সপ্তাহ পরে পড়ার কথা। ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের কথা বলে অসদুপায়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে।
বিএসডি/ এফএস