নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইস্কাটনে বিয়াম ফাউন্ডেশনে অবস্থিত বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের অফিস কক্ষে ভোরে এসি বিস্ফোরণের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ওই বিস্ফোরণে একজন অফিস সহায়ক ও একজন গাড়িচালকের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। যা পরে গণমাধ্যমে খবরও হয়।
পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইঅ্যান্ডও) প্রায় তিন মাস তদন্তের পর বলছে, এসি বিস্ফোরণ নয়, এটি ছিল একরকম হত্যাকাণ্ড। উদ্দেশ্য ছিল নথি পোড়ানো, পুড়ে যায় মানুষ। হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল না আসামিদের, কিন্তু পেট্রোল ঢেলে নথিপত্র পোড়াতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যায়। আগুন লাগিয়ে নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার জন্য চুক্তি হয় ১২ লাখ টাকায়।
পিবিআই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিকে শনাক্ত করে এবং পরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সহায়তায় গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলেন— ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম (৩৮) এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৬)।
গত ২৫ জুলাই তাদের কুড়িগ্রাম ও ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কল্যাণপুরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উত্তর (এসআইঅ্যান্ডও) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান।
তিনি বলেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়াম ভবনের ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রচণ্ড শব্দসহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে ওই কক্ষে রক্ষিত সমিতির দলিলপত্রাদি, নামজারি সংক্রান্তে কাগজপত্র, ব্যাংক হিসাব, চেক বই, জমি ক্রয় সংক্রান্ত ৪টি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র, কক্ষের এসি ইত্যাদিসহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
ঘটনার সময় অফিস সহায়ক আব্দুল মালেক ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়িচালক মো. ফারুক গুরুতর আহত হন। পরে জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. মশিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার আব্দুর রহমান বলেন, হাতিরঝিল থানা পুলিশ দুই মাস মামলাটি তদন্ত করে। থানা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে গত ৬ মে পিবিআই এসআইঅ্যান্ড (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার নিয়ে এসআই মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়।
পিবিআইয়ের বিশেষায়িত টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময়ের সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণে জানতে পারে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় যায় এবং সেখানকার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।
বিশেষায়িত টিম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আসামির ছবি শনাক্ত করে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআইয়ের একাধিক টিমের চেষ্টায় আত্মগোপনে থাকা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামি আশরাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্যমতে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড জাহিদুল ইসলামকে ঢাকার ভাটারার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম পিবিআইকে জানায়, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত বছরের ৫ আগস্ট-এর পর ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা ৫/৬ মাস রাখে।
জাহিদুল ইসলামের সূত্র ধরে সে প্রায়ই বিয়ামে যাতায়াত করত এবং ওই অফিসের কাজে কয়েকজনের সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম, আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আ. মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করে
পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদের ১০/১২ লাখ টাকা দেয়ার মৌখিক চুক্তি করে। একদিন জাহিদ আশরাফুলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের পঞ্চম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে। জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল স্লীপ শার্ট কেনে।
ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের পঞ্চম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়। ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক চতুর্থ তলার ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল। ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করে গাড়িচালক মালেক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আশরাফুল পঞ্চম তলা থেকে তৃতীয় তলায় নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক মালেক মারা যান। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড্রাইভার ফারুক মৃত্যুবরণ করলে জাহিদ আশরাফুলকে ডেকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলে।
জাহিদের কথামতো পরদিন তিনি রংপুর চলে যান। এই কাজে আশরাফুলকে প্রতিশ্রুত ১২ লাখ টাকার মধ্যে ৭ লাখ টাকা দিয়েছেন জাহিদ।
গত ২৬ জুলাই বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম ও আশরাফুলকে আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।